সমুদ্রপথে ইউরোপযাত্রায় দুই দিনে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরলেন ১২০ বাংলাদেশি, এখনো নিখোঁজ ১৩ জন, ‘গেম’-এর অপেক্ষায় আরও শতাধিক, ৮-১০ লাখ টাকা খরচ প্রত্যেকের
স্বপ্নের ইউরোপের জন্য বাংলাদেশিদের মরণযাত্রা থামছেই না। ইতালি পৌঁছাতে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর কবল থেকে গত দুই দিনে উদ্ধার হয়েছেন ১২০ বাংলাদেশি। এর মধ্যে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে যাওয়ার পর নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার হয়েছেন ৬৮ বাংলাদেশি। আরেকটি ভাসমান নৌকা থেকে উদ্ধার হয়েছেন আরও ৫২ বাংলাদেশি।
তবে নৌকাডুবির পর এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। তাদের উদ্ধারে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। কিন্তু সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবিত উদ্ধারের আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। নৌকার বেশির ভাগ বাংলাদেশির বাড়িই মাদারীপুরে। তাই জেলার দুই উপজেলায় নিখোঁজদের বাড়িতে চলছে মাতম। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরা লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাদের জানান, দালালের মাধ্যমে ১৭ মে লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল থেকে ইতালির উদ্দেশে একটি নৌকায় রওনা দেয় ৯০ জনের একটি দল; যার বেশির ভাগই বাংলাদেশি। কয়েকজন নাইজেরিয়া ও মরক্কোর নাগরিকও ছিলেন।
২৪ ঘণ্টার বেশি সময় সাগরে ভাসতে থাকার পর নৌকাটি ১৮ মে রাতে খারাপ আবহাওয়ায় তিউনিসীয় এসফ্যাক্স উপকূলে ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার সমুদ্রে তেলের খনিতে কর্মরত শ্রমিকরা নৌকাটি ডুবে যেতে দেখেন। পরে খনির বিভিন্ন অবকাঠামো ধরে কয়েক ঘণ্টা সাগরে ভেসে থাকেন ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রীরা। খবর পেয়ে তিউনিসিয়া নৌবাহিনীকে উদ্ধারকাজের জন্য পাঠানো হয়। পরদিন তিউনিসিয়া নৌবাহিনী ৩২ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করে জারজিস নৌবন্দরে নিয়ে আসে। এর পরদিন তারা আরও ৩৬ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে আসে।দুই দিনে মোট ৬৮ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। খবর পেয়ে তিউনিসিয়ার ঘটনাস্থলে যান লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। লিবিয়ার দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তিউনিসিয়ার উপকূলে ঝড়ের কবলে পড়ে সাগরে ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে মোট ৯০ জন ছিলেন। এর ৮১ জনই বাংলাদেশি।
বাকিরা নাইজেরিয়া ও মরক্কোর নাগরিক। এর মধ্যে ৬৮ বাংলাদেশিসহ ৭৭ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে তিউনিসিয়া নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড। বাকিরা নিখোঁজ আছেন। দূতাবাস কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশিসহ উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও রেড ক্রিসেন্টের তত্ত্বাবধানে জারবা ও এসফ্যাক্স শহরের হোটেলে রাখা হয়েছে। করোনা বিধির কারণে তাদের সবাই সাত দিনের কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন এবং করোনা পরীক্ষাও করা হয়েছে। প্রথম উদ্ধার হওয়া ৩২ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়ার দ্বীপশহর জারবায় রাখা হয়েছে।এদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিস্তারিত পরিচয় ও ঘটনা সম্পর্কে জেনেছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। তবে তিউনিসিয়ায় করোনা নিয়ে কড়া সতর্কতা থাকায় তাদের চলাচল সীমিত করা হয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় দফায় উদ্ধার হওয়া ৩৬ বাংলাদেশিকে প্রথমে এসফ্যাক্স শহরে নৌঘাঁটিতে নেওয়া হয়। তার মধ্যে দুজন করোনা পজিটিভ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এসফ্যাক্সের হোটেলে রাখা হয়েছে। এ ৩৬ জনের সঙ্গে এখনো দূতাবাস কর্মকর্তারা সরাসরি সাক্ষাতের অনুমতি পাননি। তবে বিভিন্নভাবে তাদের খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।দ্বিতীয় দফায় উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরা একটি ফেসবুক ভিডিওবার্তায় সুস্থ আছেন দেখা গেছে। চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির বলেন, ‘আমরা আইএমও ও রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানান, প্রথম দফায় উদ্ধার হওয়া ৩২ বাংলাদেশির মধ্যে রয়েছেন- মাদারীপুরের মনির বেপারি, ইমরান মাতুব্বর, জীবন ফরাজী, সাইফুল ফরাজী, বিল্লাল ফরাজী, জিহাদ মাতুব্বর, অনীক মাতুব্বর, মহিউদ্দিন ফরাজী, সাগর মালাকার, মীর, অনীক তালুকদার, রাশেদ জমাদার, রাব্বী বেপারি, রানা মাতুব্বর, শাহিন হাওলাদার, হাফিজুল হাওলাদার, হৃদয় তালুকদার, শুক্কুর মুন্সি, শাহজালাল শেখ, হুমায়ুন হাওলাদার, রাজীব বেপারি, রণি, আল আমিন ফকির, কুষ্টিয়ার জাহাঙ্গীর মন্ডল, ফরিদপুরের সোহেল রানা,বরিশালের আল আমিন খান, গোপালগঞ্জের রাসেল, নারায়ণগঞ্জের মহসিন ইসলাম, ঝিনাইদহের রাশিদুল ইসলাম, সোহেল রানা, গাজীপুরের মামুন শেখ, নোয়াখালীর ফয়সাল হোসেন।
উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরা জানান, বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে তরুণ ও যুবকদের একটি বড় দল গত কয়েক মাসে লিবিয়া গিয়ে পৌঁছায়। বেশির ভাগই ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে দুবাই হয়ে লিবিয়া গেছেন। প্রায় দুই মাস অপেক্ষার পর ১৭ মে রাতে তাদের ‘গেম’-এর সময় আসে। লিবিয়া থেকে নৌকায় ইউরোপের পথে এই যাত্রাকে তারা ‘গেম’ বলেন। সাধারণত এক থেকে দেড় সপ্তাহ আগে এ গেমের সময় জানা যায়। সে হিসেবে আগামী দুই সপ্তাহে আরও শখানেক বাংলাদেশি ‘গেম’-এর অপেক্ষায় আছেন। এদের কেউ যাবেন প্লাস্টিকের নৌকায়, কেউ কাঠের নৌকায়। কিন্তু কার ভাগ্যে কী আছে কেউ জানেন না।
গেম’ করে আসা অর্থাৎ নৌকায় রওনা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে লিবিয়ায় ফেরত আসা মাসুদুর রহমান বলেন, ‘লিবিয়া থেকে ৮ মে রওনা দিয়েছিলাম। এক দিন পরই ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। আর নৌকায় কোনো চালকই ছিল না। যাত্রীদের একজনকে চালক বানানো হয়েছিল। তাই ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার পর কারও কিছু করার ছিল না। আমরা চার দিন চার রাত শুধু সাগরেই ভেসেছি। খাবার ছিল না, পানিও ছিল না। মৃত্যু কাছ থেকে দেখেছি। পরে শিপ এসে আমাদের উদ্ধার করে লিবিয়ার গার্ডের হাতে দেয়। ’
চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির বলেন, ‘ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রীদের উদ্ধারের আগে সোমবার তিউনিসিয়ার উপকূলে ডুবতে যাওয়া আরাও একটি নৌকা থেকে তিউনিসিয়া নৌবাহিনী ১১৩ জনকে উদ্ধার করে। সেখানেও মরক্কো ও সাব-সাহারা আফ্রিকার অধিবাসীদের সঙ্গে ৫২ বাংলাদেশি ছিলেন। সেদিন উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের মেদরিন শহরে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তিউনিসিয়ায় উদ্ধার হওয়া সব বাংলাদেশিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, একের পর এক দুর্ঘটনার পরও অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েই চলেছে। দিন দিন বাড়ছে দালালের দৌরাত্ম্য। কৌশল পাল্টে ইউরোপে পাঠাতে সহজ সরল মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তারা। অনেক দিন ধরেই দালালরা সাগরপথে লোকজনকে ইউরোপে পাচার করতে সক্রিয়। লিবিয়ার অস্থিরতার কারণে দালালরা এ সুযোগ নিচ্ছে। তারা নানা কৌশল ও প্রলোভনে অনেককে ফাঁদে ফেলছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অনেকেরই ধারণা মূলত ইউরোপে গেলেই ভাগ্য ফিরবে- এমন আশাতেই লোকজন যাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্যমতে, ইউরোপ অভিমুখে শরণার্থীর যে স্রোত তাতে অন্যান্য দেশের সংখ্যা কমে এলেও বাংলাদেশির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি (সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট) যাচ্ছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি। এভাবে যেতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলারডুবি হচ্ছে। ইউরোপের জেলে বন্দী রয়েছেন অনেকে। কেউবা গ্রেফতার হয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে শূন্য হাতে ফিরছেন দেশে।