ছাপাখানায় বড্ড ব্যস্ততা। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই একটুও। আশা আর আশঙ্কার অদ্ভুত এক সময়। অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসছে আলো। পদ্মা, মেঘনায় উথালপাথাল ঢেউ। তীব্র প্রসব বেদনা। জন্ম নিচ্ছে নতুন দেশ, নতুন জাতি
একটি পতাকা। জাতীয় সংগীত। স্বপ্নে বিভোর সাত কোটি বাঙালি। আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র বত্রিশ নম্বর। শুধু কয়েকটি মাস বা মুহূর্তের ইতিহাস তো নয়। বঙ্গবন্ধু একটি জাতিকে প্রস্তুত করেছেন বছরের পর বছর ধরে। সাতই মার্চ ডাক দিলেন তিনি। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জল্লাদরা ইতিহাস লিখতে চাইলো অন্যভাবে। পঁচিশে মার্চ কালরাতে চূড়ান্ত আঘাত হানে তারা। হঠাৎ বদলে গেল সব। মানুষের ঘুম ভাঙলো অস্ত্রের ঝনঝনানির শব্দে। লাশের মিছিল। গোঙানির শব্দ। প্রতিরোধের চেষ্টাও হলো কোথাও কোথাও। গ্রেপ্তার করা হলো বঙ্গবন্ধুকে। ছাব্বিশে মার্চ উনিশশো একাত্তর। জন্ম নিলো একটি নতুন দেশ। আজ তার সুবর্ণ জয়ন্তী। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন সুবর্ণ জয়ন্তীকে করেছে আরো মহিমাময়।
চরম নিষ্ঠুরতা। মৃত্যুর ঘন অন্ধকার। ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ। মুক্তির স্বপ্ন। অসীম সাহসিকতার জনযুদ্ধ। অপরিসীম ত্যাগ। বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ। পঞ্চাশ বছর পর কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এ এক বিস্ময়কর উত্থানের গল্প। এতোটাই যে বলা হচ্ছে, সহসাই বিশ্বের পঁচিশতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। মেগা প্রকল্প। সামাজিক সূচকেও প্রশংসনীয় অগ্রগতি। কিন্তু এটাই কি গল্পের সবটা? হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এ প্রশ্ন উদিত বহু মানুষের মনে-এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম। গরিব দেশের চক্র ছিন্নভিন্ন করা দেশে গণতন্ত্র কোথায়? মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমতা আর ইনসাফের গল্পও কি হারিয়ে গেল। কে না জানে এসবই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার।
অর্থনীতিতে বিস্ময়কর অর্জন: বার্তা সংস্থা এএফপি’র কাছে তার জীবনের গল্প বলেছেন গার্মেন্ট শ্রমিক রুমা। তার মা ডায়রিয়ায় মারা যান ১৯৮০-এর দশকে। তাকে আত্মীয়দের সঙ্গে বসবাস করতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তার এক আত্মীয় সব বইপত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। কারণ, তার মতে মেয়েদের জন্য শিক্ষা নয়। গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। রুমা এখন কোনো কোনো মাসে ৪২০ ডলার পর্যন্ত আয় করেন। ঈদের সময় তিনি ও তার স্বামী এক হাজার ডলারের বেশি নিয়ে বাড়ি যান। মাসে দুই সন্তানের পড়াশোনার জন্য তারা খরচ করেন ১২০ ডলার। গাজীপুরের আবর্জনাময় শিল্প এলাকায় কংক্রিটের দুই রুমের বাসায় বসে রুমা বলেন, আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, আমার সন্তানের শিক্ষা বঞ্চিত রাখবো না।
গার্মেন্টস কারখানা রুমার মতো অনেকের জীবনই বদলে দিয়েছে। প্রবাসী আয় আর পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে এগিয়ে চলছে দেশের অর্থনীতি। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারি সবকিছু ওলটপালট করে দিলেও সেই ধাক্কাও সামাল দিয়েছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১৯৭১ সালে যে দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত ছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ১০ লাখ মানুষকে একসঙ্গে আশ্রয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আকার বহু গুণে বেড়েছে। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। দারিদ্র্যবিমোচনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। রপ্তানি খাতে বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, মহামারির প্রেক্ষাপটে ‘পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো অবস্থায়’ রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক শিল্প। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পাওয়া যায় না। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। পোশাকের পাশাপাশি বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৮০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশীয় ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোসহ অন্য কারখানাগুলো দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ ওষুধ জোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ জীবন বাঁচাচ্ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচের মানুষের।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩০শে জুন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উত্থাপন করা হয় জাতীয় সংসদে। সেই বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭২২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। এ ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ১৯৭২ সালে ছিল ৫০১ কোটি টাকার, যা ২০২০ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকায়। দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮.১৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু মহামারির মধ্যে দুই মাসের লকডাউন আর বিশ্ব বাজারের স্থবিরতায় তা বড় ধাক্কা খায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২৪ শতাংশে নেমে আসে।
এ বছরের একটি আলোচিত বিষয় ছিল মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে বাংলাদেশের পেছনে ফেলার পূর্বাভাস। আইএমএফ’র ওই পূর্বাভাস নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। অর্থাৎ ৫০ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ। স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে আশানুরূপ অর্জন এসেছে রপ্তানি বাণিজ্যেও। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয় মাত্র ৩৪ কোটি ডলার। সবশেষে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪০.৬ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৬০ কোটি ডলার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৮ বিলিয়ন ৭৫ লাখ ডলার বা ৮০০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বর্তমানে জিডিপি’র আকার ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে মহামারির মধ্যেই রিজার্ভ ৪৪.১২ বিলিয়ন (৪ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি।
১৯৭১ সালে যেখানে দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো, সেখানে চলতি বছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিল ২০.৫০ শতাংশ। ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছরের একটু বেশি। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২.৬ বছর। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টন। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের মহাসড়কে নিতে কাজ চলছে ১০টি মেগা প্রকল্পের। পদ্মা সেতু প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও কর্ণফুলী টানেল। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা বাংলাদেশের আছে। কীভাবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে হবে, সেটা বিবেচনায় আনতে হবে। এজন্য বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালানিসহ অবকাঠামো দ্রুত করতে হবে। দারিদ্র্যবিমোচনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে।
রাজনীতিতে ছন্দপতন: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে ব্যালটের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ নিরঙ্কুশভাবে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে ভোট দেয়। এরমাধ্যমে মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিই অনাস্থা প্রকাশ করে তারা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ড্রয়িংরুম থেকে রাজনীতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন মানুষের মাঝে। সেমন্তী ঘোষ তার এক লেখায় যেমনটা লিখেছেন, ‘মুজিব মাঠেঘাটে ঘাম ঝরিয়ে রাজনীতি করা মানুষ। জিন্নাহ্র মতো নেতারা মানুষের ‘উপরে’ নিজেদের রাখতেন। মুজিবের মতো নেতারা মানুষের ‘মধ্যে’ মিশে যান, মানুষের আবেগের সঙ্গে নিজের আবেগকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নেন। এমন যারা হন, তারা কেবল নেতা নন, তারা যেন রূপকথার নায়ক। জিন্নাহ্রা দেশ তৈরি করেন রাজনীতির প্যাঁচ-পয়জার দিয়ে। আর মুজিবরা, রক্তকণিকা আর অশ্রুজল দিয়ে দেশ বানিয়ে তোলেন, অত্যাচারিত, নিপীড়িত সমাজের দেশ। এ কেবল আবেগের কথা নয়, আক্ষরিকভাবে সত্যি কথা। সত্যিই তার রাজনীতিতে মিশে আছে হাজার মানুষের চোখের জল, দেহের রক্ত। সেই দিক দিয়ে তার সঙ্গে বরং তুলনা চলতে পারে হয়তো গ্যারিবল্ডির কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার।’
স্বাধীন দেশের শুরু থেকেই বারবার বাধার মুখে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে হত্যা করা হয় রাজনীতির স্বাভাবিক ধারাকেই। এরপর দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশ। ভোটের নামে নানা ধরনের মশকরা তখন দেখেছে মানুষ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এটি সরল পথে চলেনি। ভোট নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে বারবার। জনগণ বহুক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে ভোটাধিকার থেকে। নানা গৌরবের অর্জন ম্লান হয়েছে এতে। মানবাধিকার আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের মতো বিষয়গুলোও সামনে এসেছে বার বার। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, বর্তমানে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বিবিসিকে বলেন, এ রকম একদলের প্রভাব থাকা গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়। বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা কখনোই চাইতেন না বঙ্গবন্ধু।