শুক্রবার সকাল! রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট! ৯ নম্বর শয্যার (বেড) সামনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসক নরম সুরে ডাকলেন, ‘তাহিয়া, চোখ খোলো…।’ কিন্তু ফোলা চোখ–মুখ নিয়ে শুয়েই থাকল শিশুটি। কিছুতেই চোখ খুলতে পারল না।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাহিয়া আহমেদের (১০) মা মোহসিনা বেগম। নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে যাচ্ছে তাঁর বুক। তাঁরও হাতে ব্যান্ডেজ। তিনি একবার ৯ নম্বর বেড, আরেকবার ১২ নম্বর বেড, খানিক পরেই ছুটছেন পাশের ১৩ নম্বর বেডের দিকে।
১২ নম্বর শয্যায় মোহসিনার আরেক মেয়ে তাসনিয়া আহমেদ (৬)। আগুনে তার হাত ও মুখের অনেকটা পুড়ে গেছে। আর ১৩ নম্বর শয্যায় শুয়ে আছেন মোহসিনার শাশুড়ি শামসুন্নাহার বেগম (৬৫)। তাঁর মুখমণ্ডল পুড়ে গেছে। আর মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তাঁর শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি শঙ্কামুক্ত নন বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
এই পরিবারটির আট সদস্য ছিলেন গতকাল বৃহস্পতিবার কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া বাসটিতে। তাঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন ঘটনাস্থলেই। আর এখন হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনজন। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
তাহিয়ার বাবা মো. উজ্জ্বল মিয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক। তিনি জানালেন, ঢাকা থেকে তাঁরা সবাই (আটজন) গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। মতলব এক্সপ্রেস বাসটি ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। বাসটি দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুরে পৌঁছে একজন যাত্রীকে নামানোর জন্য ব্রেক কষে। তখন বাসের মধ্যেই একটা শব্দ হলো। এরপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুন ধরে যায়। সামনের দরজা পর্যন্ত গিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ার অবস্থা ছিল না। তিনি ও তাঁর দুই মেয়ে এবং পরিবারের অন্যদের জানালার কাচ ভেঙে নিচে নামেন। তবে বাঁচাতে পারেননি তাঁর বাবাকে। আগুন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
বিষণ্ন কণ্ঠে উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘আমার বড় মেয়েটা বলছিল, “বাবা, আমাকে বাঁচাও।” ওদিকে আগুন এত বেড়ে গেল! আমার বাবা পুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। মেয়েকে জানালা দিয়ে নামালাম ঠিকই। কিন্তু বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না।’
ছয় বছরের তাসনিয়া ক্লাস ওয়ানে এ বছর আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। চোখ খুলে মাকে কাছে দেখতে না পেয়ে সে বুঝে নেয় মা হয়তো বোনের কাছে গেছে। ততক্ষণে তাহিয়াকে ড্রেসিং করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় অন্য কক্ষে
কেমন আছো—জিজ্ঞেস করাতেই তাসনিয়া বলে, ‘ভালো।’ এরপর বলে, ‘আমরা দাদুর বাড়িতে যাচ্ছিলাম, কুমিল্লা। তখন আমরা প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। তারপর বাসে আগুন ধরে গিয়েছিল। তারপর আমরা কোনো রকমে জানালা দিয়ে বের হয়েছিলাম।’
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের ১৬ নম্বর শয্যায় শুয়ে আছেন আরেক দগ্ধ নারী রওশন আরা বেগম (৪৫)। তাঁর ছেলে মোহন কাজী জানান, তাঁর মা নাতিকে সঙ্গে নিয়ে ছোট ভাইয়ের বাসা ঢাকা থেকে মতলবে যাচ্ছিলেন নানাবাড়িতে। তখন সিদ্ধিরগঞ্জ বন্দরে তিনি কর্মস্থলে ছিলেন। মাগরিবের নামাজের সময় অন্য একজনের কাছে খবর পেয়ে তাঁরা দুই ভাই গৌরীপুর যান। তাঁর ভাইয়ের ছেলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছে বলে জানালেন মোহন কাজী।
চিকিৎসকেরা বলছেন, রওশন আরা বেগমও শঙ্কামুক্ত নন। যদিও তাঁর শরীরে দগ্ধ হওয়ার হার ১২ শতাংশ। কিন্তু তাঁর শ্বাসনালি আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তাঁরা।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ও সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মামুন খান বলেন, ১৮ জনকে আনা হয়েছিল বার্ন ইউনিটে। তাঁদের মধ্যে এখন ছয়জন আছেন। এঁদের চারজন পর্যবেক্ষণে আছেন। তাঁদের নিয়ে শঙ্কা কম। এঁদের মধ্যে গোলাম হোসেন (৭৫) নামে একজনের শরীরের ৩১ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি আইসিইউতে আছেন।
চিকিৎসক মামুন খান আরও বলেন, ‘এটা এখনো দুর্ঘটনা কি না, পরিষ্কার জানা যায়নি। তবে যাত্রীবোঝাই বাসে এভাবে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা আর মনে পড়ে না। এটি চিন্তার বিষয়। এখানে অবহেলা ছিল কি না, নির্দিষ্ট সময় পরপর এগুলো পরীক্ষা করা হয় কি না, সেটা দেখার বিষয়।’