সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা ঘটনার পর কক্সবাজার এলাকা কেন্দ্রিক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময়কালে মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা সীমান্ত পার হয়ে আসলেও তা আর দেশে ঢুকতে পারছে না—এমনটাই দাবি র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের। মন্দা ব্যবসা চাঙা করতে পরপর একাধিক বড় চালান ঢোকানোর চেষ্টা করেছে মাদক কারবারিরা। কিন্তু র্যাব আর বিজিবির অভিযানের মুখে সে চালান কক্সবাজারের সীমানা পার হতে পারেনি।
র্যাবের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের চারটি চালান আটকে যাবার পর বিপাকে পড়েন দুই দেশের মাদক কারবারিরা। বাজার চাঙা রাখতে এই চালানগুলো বাকিতে বিক্রি করেছিল মিয়ানমারের কারবারিরা। কিন্তু এত টাকার ইয়াবা চালান ধরা খাওয়ার পর বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তারা।
এ সুযোগে পূর্বের পরিচয়, ভাষাগত সাদৃশ্যসহ বেশ কয়েকটি কারণে মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীরা বেছে নিয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা যুবকদের। গড়ে তুলেছে মাদকের নতুন সিন্ডিকেট। আর সেই সিন্ডিকেটে বাংলাদেশি কারবারিরা কেবল বহনকারী হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের মূলধন না থাকায় মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা বাকিতেই ইয়াবা বিক্রি করছে তাদের কাছে। বিক্রি করা শেষেই টাকা দেবে তারা। এমন ধার ব্যবসায় আবার জমজমাট হতে শুরু করেছে ইয়াবা বাজার।
কক্সবাজার এলাকায় র্যাবের বিশেষ ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমানে ইয়াবা সিন্ডিকেট চালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। আমির-আনাস-মুন্না-জাকির-ইয়াসিররাই মূলত নতুন সিন্ডিকেটের গডফাদার। আমরা সম্প্রতি অভিযানে যাদের আটক করেছি, তাদের কাছ থেকে এই নামগুলোই বারবার শুনেছি।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি ক্যাম্পে যে ঝামেলা চলছে, তার মূল কারণ আধিপত্য বিস্তার। আর এটা মাদক চালানের আধিপত্য। কে পার করে আনবে। কে কত শতাংশ টাকা ভাগ পাবে। এসব নিয়েই মূল ঝামেলা।
মাদক নিয়ে কাজ করা একাধিক বাহিনীর সূত্র বলছে, ইয়াবার পাচারের রুট কিছু দিন পরপরই বদলায়। একাধিকবার কোনও রুটে চালান ধরা পড়লে পরবর্তী ৬ মাসে ওই রুট ব্যবহার করা হয় না। ছয় মাস পর আবার যদি ওই রুটে সফল হয়, সেটা তার পরের তিন মাস চলমান থাকে। সে হিসেবে বর্তমানে শাহপরীর দ্বীপ, দমদমিয়া, লেদা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীয়াপাড়া, শাপলাপুর, সাতঘরিয়াপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়ার আমতলি, ঘুমধুম, তমব্রু, বেতবুনিয়া, আশারতলীসহ অন্তত ৩০টি রুট দিয়ে ইয়াবার চালান ঢুকছে।
গত মাসের (২৪ অক্টোবর) কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মাঝিরঘাট এলাকা থেকে ১৩ লাখ পিস ইয়াবার একটি বড় চালান জব্দ করেছে র্যাব। ইয়াবাগুলোর মূল্য আনুমানিক ৬০ কোটি টাকা। এই অভিযানে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের এইচ-১৪ ব্লকের বাসিন্দা মো. আয়াছ (৩৪) ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ হাজীপাড়ার মো. বিল্লাল (৪৫) নামের দুই জন আটক হয়। র্যাব জানায় এই চালান এসেছিল মিয়ানমার থেকে। মূল চালান স্থানীয় পুরনো ইয়াবা সিন্ডিকেটের।
তার আগে (১৭ আগস্ট) কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন (৩৪ বিজিবি) বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৩নং ঘুমধুম ইউপি’র দক্ষিণ রেজুআমতলী মসজিদের পাশের পাহাড়ের ঢালুতে থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার পিস বার্মিজ ইয়াবা উদ্ধার করে, যার বাজার মূল্য ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই চালানেরও মূল স্থানীয় বাংলাদেশি সিন্ডিকেট। উভয় ইয়াবা চালানই বাকি এসেছিল। মাল বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ইয়াবা জব্দ হওয়ায় মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে দুই দেশের কারবারিদের। আর তখন মিয়ানমারের কারবারিরা রোহিঙ্গা মাদক সিন্ডিকেটকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে।
এসব বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস) ড. এএফএম মাসুম রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগে থেকে মাদকের চালান আসা অনেকটা কমেছে। বর্তমানে ইয়াবা পাচারে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। পূর্ব চেনাজানার কারণে মিয়ানমারের কারবারিরা তাদের বাকিতেও কোটি কোটি টাকার ইয়াবা দিচ্ছে। চালান পার করে টাকা পরিশোধ করছে। এসব ক্ষেত্রে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে তারা। আমরা তাদের ওপর নজর রাখছি।
সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও কেন তাদের ধরা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের কর্মকর্তা মেজর মেহেদি হাসান বলেন, ক্যাম্পের একই ব্লকে এক নামের ১০০/১৫০ জন মানুষ থাকে। তাদের পরিচয়পত্র নেই। ইউএন থেকে তাদের যে কার্ড দেওয়া হয়েছে, সার্ভারে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার চেয়ে বড় কথা, তাদের মধ্যে অন্যায় কাজে ব্যাপক ইউনিটি আছে। সেখানে সোর্স গড়ে তোলা কঠিন। তারপরও একাধিকবার ড্রোন ব্যবহার করে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। সবক্ষেত্রে সফল হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এমন পরিস্থিতিতে।
বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের ইয়াবা চোরাচালান বেড়েছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাহিনীটি একাধিক অভিযানে প্রায় ১৭ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার অধিকাংশ রোহিঙ্গা নাগরিক।
টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গোপন সংবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করছি। বড় ইয়াবার চালানও জব্দ করা হচ্ছে। গডফাদার হিসেবে রোহিঙ্গাদের নাম আসছে। তাদের বিরুদ্ধেও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ বলছে, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকে জড়িত। সেখানকার অনেক কারখানায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। এখন ব্যবসা চালিয়ে যাবার লক্ষ্যে তারা বাকিতে ইয়াবা দিচ্ছে। আর এ কাজে রোহিঙ্গাদেরই তারা বেশি বিশ্বাস করছে।