বিষণ্ণতা একটি রোগ। একটি মানসিক সমস্যা। বিষণ্ণতায় ভোগলে বেশ কিছু দিন ধরে হতাশা, মন খারাপ এবং সবকিছুর প্রতি অনিহা বোধ হয়। প্রকাশ পায়-বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ। বিষণ্ণতার কারণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, শিক্ষাগত, পেশাগত ও সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা।
প্রাইভেট পড়ার সময় অমনোযোগী দেখে আমাকে উদ্দেশ্যে করে কথা গুলি বলেছিলেন, জাহেদ স্যার। পুরো নাম জাহেদুল ইসলাম। উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক। লালু, বশির, করিম, পলাশ, বশর, মর্জিনা, আর আমি স্যারের নিকট ইংরেজি পড়তাম। স্যার ছিলেন ইয়ং এবং স্মার্ট। সবেমাত্র পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করেছেন। খুবই আন্তরিকতার সাথে পড়াতেন।
প্রাইভেট পড়ার সময় বার বার অন্যমনস্ক দেখে কথা গুলি বলে ঐদিনের মতো আমাকে ছুটি দিয়ে ছিলেন।
কেন এই বিষণ্ণতা আমার উপর ভর করল?
বাড়ির সামনেই সিও সাহেবের পাহাড়(সিও – সার্কেল অফিসার)। এটি উখিয়া উপজেলা পরিষদ পাহাড়ের পূর্ব নাম। সিও’র পাহাড় দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনিট দু-এক হেঁটে সিও’র পাহাড়ে উঠতে হয়। প্রথমে একটি টিনসেড আধাপাকা দালান, যেটি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানে যুবসমাজকে সেলাই ও বাঁশ বেতের জিনিষপত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পূর্ব পাশে দুর্বার মাঠের উপরে টিলায় একটি দু’তলা দালান।
দু’তলা দালানের নিচ তলায় স-পরিবারে থাকতেন পিআইও সাহেব। আর দ্বিতীয় তলায় থাকতেন উপজেলা মৎস্য অফিসার করিম সাহেব(ছদ্ম নাম)।
পিআইও সাহেব দালানের উত্তর পাশে শাক-সবজি আর পেঁপের চাষ করতেন। সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে দেখতাম, তিনি পেঁপে গাছ আর সবজি বাগানের পরিচর্যা করছেন। মাস তিনেক পর দেখি একটি পেঁপে গাছে চারটি পেঁপে ধরেছে। আরও কিছু দিন পরে দেখলাম একএকটি পেঁপে ৩/৪ কেজির মতো ওজন হয়েছে। এতো বড় পেঁপে জীবনেও দেখিনি। না জানি এই পেঁপে কত স্বাদের হয়!
পেঁপে গুলির প্রতি আমার লোভ হলো। একদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সিও’র পাহাড়ের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। তখনো আবছা আঁধার। ভোরের আলো ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত গতিতে হেঁটে পিআইও সাহেবের পেঁপে গাছের নিকট গেলাম। চারদিকে ভালোভাবে দেখলাম। এখনো কেউ জেগে ওঠেনি। হয়তো সাহেবরা এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে না। খুবই সাবধানে বড় দুইটি পেঁপে ছিড়ে নিয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরলাম। কুইজ্জার (খড়ের স্তুপ) ভিতর পেঁপে দুটি লুকিয়ে রাখলাম।
দৈনিক কমপক্ষে একবার দেখি পাকছে কিনা আর ভাবি, না জানি কত স্বাদ হয়। চার দিন পর একটু একটু নরম হয়েছে।
বিকালে বাবা ঘর থেকে বের হওয়ার পর পেঁপে দুটি কুইজ্জার ভিতর থেকে এনে পড়ার টেবিলে রাখলাম। দা নিয়ে একটি পেঁপে কাটব এমন সময় মা’র ডাক। এই পেঁপে কই পেয়েছ?
জবাবে বললাম, পিআইও সাহেবের গাছ থেকে। সাথে সাথে মা দা’টি কেড়ে নিল। মাইনষের (পর মানুষের) গাছের পেঁপে চুরি। এইনি তোরে স্কুলে শিক্ষা দিছে, বলেই- দুই গালে কষে দুই থাপ্পড় (চড়) বসিয়ে দিল। চড় খেয়ে পেঁপের কাঙ্ক্ষিত স্বাদ আস্বাদনের পূর্বেই মনটা বিষাদে ভরে উঠলো।
মা আমাকে দুই চড় দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। বলল, চল আমার সাথে। পেঁপে দু’টি একটি পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে আমাকে নিয়ে পিআইও সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা হলেন। পিআইও’র বাসার পিছনের দরজায় মা কড়া নাড়ছে। আমি লজ্জায় ও ভয়ে কুটির শিল্পের কাছে চলে এলাম।
এদিকে বিল্ডিং এর সামনে পড়ন্ত বিকেলে খোলা জায়গায় এক সুন্দরী যুবতী এদিক সেদিক হাঁটছে। গায়ে তুষারশুভ্র বসন।গলায় প্যাঁচানো বুকের উপর ঝুলানো নীলচে রঙের ওড়না ইউ আকৃতি ধারন করেছে। কোমর অবধি দীর্ঘ ভ্রমরকৃষ্ণ চুল বিকেলের সমীরণে গায়ের শুভ্রবসনে ঢেউখেলছে।
হঠাৎ কোন দিক থেকে কেউ যেন যুবতীর গায়ে ঢিল ছুড়ল। যুবতী এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকে দেখল না। খানিক দূরে আমাকে দেখে লম্বা কদমে এগিয়ে এসে বলল-
ঢিল কে মেরেছে?
– আমি দেখি নাই।
কর্কশ ভাষায় হুংকার দিয়ে আবার বলল, “ফাজলামি কর, মেয়ে লোক কখনো দেখ নাই” বলেই হন হন করে বারান্দার কাছে ফিরে গেল।
আমি বাকরুদ্ধ। সপ্তদশী সুন্দরী যুবতী বয়সে আমার ছেয়ে বছর তিনেক বড় হবে। বিনাদোষে এভাবে আমাকে শাসিয়ে গেল।
এক পেঁপে কাণ্ডের কারণে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, এখন আবার নারী কেলেঙ্কারি!
খানিকক্ষণ পর আবার যুবতীর গায়ে ঢিল। এবার ঢিলটি যুবতীর বুকে পড়ে তুষারশুভ্র কামিজে লাল দাগ পড়েছে। যুবতীর কমলাক্ষ লড়াইরত ষাঁড়ের চক্ষুুর ন্যায় লাল করে, বুকে ঝুলানো ইউ আকৃতির ওড়না কোমরে শক্ত করে বেঁধে বদু বলির মতো ডানে-বামে টহল শুরু করছে। (বদু বলি- আশি’র দশকের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার অন্যতম সেরা কুস্তিগির। যার খ্যাতি কিংবদন্তি তুল্য)
বদু বলির মতো টহল দেখে আমার শরীর বরফশীতল হয়ে গেল। বুকে ধুকধুক করছে। এবার রেহাই নেই। নিশ্চিত বদু বলির মতো মাথায় তুলে আছাড় দিবে। কারণ আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তার অব্যাহত টহল আর রক্তচক্ষু দেখে আমার দেহে মৃদু ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে।
যুবতীটি মৎস্য অফিসার করিম সাহেবের শ্যালিকা। আমি ছাদের দিকে তাকালাম। দেখি মৎস্য অফিসার সাহেব পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পনে ছাদের রেলিং এর নিকট এসে নিচের দিকে তাকালেন। নিচের দিকে ঝুকে টহলরত শ্যালিকাকে লক্ষ করে আরও একটি ঢিল ছুড়তেই ঢিলের সাথে নিজেও দু’তলার ছাদ থেকে পড়ে চিৎপটাং হলেন।
আমি কাছে গিয়ে দেখি নাক-মুখ থেকে ফেনা-ফেনা রক্ত বের হচ্ছে। তার শ্যালিকা দিদি-দিদি-বলে চিৎকার দিচ্ছে। দৌড়ে গেলাম ইউএনও অফিসের সামনে। মাজেদ হাক্কু (কাকা) কে দেখে মৎস্য অফিসার করিম সাহেব ছাদ থেকে পড়ে অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা বললাম।
মাজেদ হাক্কু হচ্ছেন তৎকালীন উখিয়া উপজেলা পরিষদের দারোয়ান (বর্তমানে প্রয়াত)। হাক্কু আরএক কর্মচারীকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসলেন। মৎস্য অফিসার করিম সাহেবকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। মিনিট পাঁচএকের মধ্যে এতবড় একটি দুর্ঘটনা দেখতে হলো।
পিআইও সাহেবের এখনো কোন সাড়া শব্দ নেই। মা পেঁপের থলে নিয়ে পিছনের দরজায় দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। নাছোঁড় বান্দা পেঁপে ফেরত দিয়েই ছাড়বে। আমি ভয়ের ছেয়ে লজ্জাই বেশি পাচ্ছি। অফিসার মানুষ তার শখের পেঁপে চুরি করেছি, চোরাই পেঁপেসহ চোরকে সামনে পেয়ে কী করে আর কী বলে তা ভেবে আতঙ্কিতও হচ্ছি ।
দালান- কোঠার বাসিন্দা সম্পর্কে একটি নির্মম বাস্তব দৃশ্য অবলোকন করলাম। উপরের তলার ছাদ থেকে পড়ে একজন লোক মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে অথচ নিচের ফ্লাটের লোকজনের কোন সাড়া শব্দই নেই।
মা পেঁপের থলে হাতে কিছুক্ষণ দরজার কড়া নাড়ে আবার ডাক দিয়ে বলে, ঘরে কেউ আছেন? একপর্যায়ে দরজা খুলে কাজের মেয়ে বের হলো। মা জিজ্ঞেস করল বেগম সাহেব আছেন?
-জে-আছে।
একটু ডাকা যাবে।
-না- ডাকা যাবে না। ঘুমাচ্ছেন।
ঠিক আছে। আমি বাইরে আছি। ঘুম থেকে উঠলে বলো, পাশের গ্রামের একজন লোক এসেছে।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। মিসেস পিআইও দরজা খুলে বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে?
মা, বলল- আমি। আপনাদের প্রতিবেশী। ঐ বাড়ির লোক। আমার ছেলেটি না বুঝে আপনাদের গাছের পেঁপে দু’টি ছিড়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমি জানতে পেরে তাকে খুব মেরেছি, শাসন করেছি। পেঁপে গুলি দিতে এসেছি।
আমার মাথা হেড হয়ে গেল। লজ্জায় অপমানে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিসেস পিআইও দেখি রাগ-টাগ কিছু দেখালেন না। স্বাভাবিক ভাবে বললেন, বাচ্চা মানুষ ভুল করেছে, মারলেন কেন?
মা বলল, সাহেবের শখের পেঁপে, চুরি করে ছিড়া ঠিক হয় নাই। পেঁপে দু’টি রেখে দিন। ছেলের এমন কাজের জন্য আমি মাফ চাই। এসেছি অনেক্ষণ হয়েছে। পেঁপের থলে রেখে- আমাকে বলে, আয়, আজকে তোর বাপ আসুক, মাইনষের জিনিসে হাত— আজ সে হাত —-।
আমি বিমর্ষ বদনে পেঁপে চুরির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মার পিছু পিছু হাঁটছি। কোন ভাবেই এই লজ্জা মন থেকে দূর করতে পারছিনা।অন্যদিকে মৎস্য অফিসার করিম সাহেবের রক্তাক্ত বিভৎস চেহারাটিও ভুলতে পারছি না। বাবা বাড়িতে আসলে আরেক দফা শুরু হবে। পেঁপেও খেতে পারলাম না, উল্টো এত বড় অপমান।
রাত ৯টার দিকে খেতে বসব। ভয়ে সঙ্কুচিত হচ্ছি। বাবা এই ঘটনা শুনার পর কি মাইরটাই না দেয়!
মা খেতে ডাকল। ভয়ে ভয়ে খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ হলো। বেঁচে গেলাম। মা পেঁপে-টেপের কাহিনী তুলে নাই। কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
ঘন্টা খানেক পর একজন পুরুষ লোকের ডাক। বাড়িতে কেউ আছেন। দরজাটা একটু খুলুন। বাবা দরজা খুলে দিল। আমি উকিঁ দিয়ে দেখি পিআইও সাহেব পেঁপে দু’টি নিয়ে হাজির।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।যে পেঁপের চিন্তায় কোন কাজে মন বসাতে পারছি না, সারাক্ষণ একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেই পেঁপে নিয়েই হাজির।
ঘরে ঢুকে পিআইও সাহেব বললেন, আপনারা আমাদের প্রতিবেশী। বাচ্চা ছেলে না বুঝে, না হয় দু’টি পেঁপে ছিড়েছে। তাই বলে তাকে মারতে হবে? কই ছেলেটি? তিনি আমাকে আদর করে পেঁপে দু’টি হাতে দিয়ে বললেন- নাও, এগুলি তোমার। আমার মুখ থেকে স্বর বের হচ্ছে না।
বাবা পিআইও সাহেব কে বসালেন। মা পেঁপে কেটে দিলো। পিআইও সাহেব সহ পেঁপে খেলাম।
পেঁপে চুরির কথা মনে পড়লেই নিজের অজান্তে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। নিমজ্জিত হই বিষণ্ণতায়।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম। উপজেলা মৎস্য অফিসার করিম সাহেব ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন। আহা! দুষ্টামিচ্ছলে শালীকে ঢিল ছুড়তে গিয়ে অকালে সামিল হলেন মহাযাত্রায়।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি যে শিক্ষাটি প্রয়োজন তা হলো পারিবারিক শিক্ষা। ভদ্রতা, নৈতিকতা, উদারতা অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ আর পরের সম্পত্তির প্রতি নির্লোভ, কৃতজ্ঞতাবোধ প্রভৃতি পরিবার থেকেই অর্জন করতে হয়। একাডেমিক প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা যায়। পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা না থাকলে সে ডিগ্রি ম্লান হতে সময় লাগে না। পেঁপে চুরির এই ঘটনায় পারিবারিক যে শিক্ষা পেয়েছিলাম তা এখনো মনে প্রাণে ধারণ করার চেষ্টা করি।
পারিবারিক শিক্ষা -২
লেখক-
মোহাম্মদ আইয়ুব
অফিসার ইনচার্জ
লালমাই থানা, কুমিল্লা।