বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার কমলদুগাছী গ্রামের লুৎফর রহমানের চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে সিহাব হোসেন (১২) একমাত্র সুস্থ। পরিবারের সচ্ছলতার জন্য তাকে প্লাস্টিক কারখানায় জোর করে কাজে পাঠান মা সোনাভান। কিন্তু কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ সিহাব।
এদিকে আগুনের খবর পেয়ে সোনাভান ছুটে এসেছিলেন কারখানায়। কিন্তু ছেলেকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। তার স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) দুপুরে উপজেলার পার্বতিপুর এলাকার হবির মোড় এলাকায় বিআইআরএস’র প্লাস্টিক কারখানায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।
কান্না জড়িত কণ্ঠে সোনাভান বলেন, কারখানায় ছেলে (সিহাব হোসেন) আমার কাজ করতে চাইতো না। এরপরও তাকে জোর করে পাঠাতাম। অভাবী সংসার। আমি ও স্বামী দুজনই অসুস্থ। কারখানায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছিল ছেলে। আল্লাহ জানে ছেলে এখন কোথায়। তারে খুঁজে পেলে জোর করে আর কাজে পাঠাবো না।
নিখোঁজ সিহাব হোসেনের চাচি নাজমা বলেন, তারা গরীব মানুষ। তাদের ভাতের কষ্ট। এ কারণে ছোট ছেলে সিহাব হোসেনকে জোর করে তার মা কারখানায় কাজে পাঠান। এখন আর কাজে পাঠানোর দরকার হবে না। আবারও তাদের ভাতের কষ্ট শুরু হবে। কারখানায় আগুনে যারা মারা গেছেন তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানাই।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে আদমদীঘি উপজেলার পার্বতিপুর এলাকার হবির মোড় এলাকায় বিআইআরএস’র প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে পাঁচজন শ্রমিক মারা যান। তবে নিহতের মরদেহ এখনো শনাক্ত এবং নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় যারা নিখোঁজ আছেন তাদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ চারজনের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে।
নিখোঁজদের স্বজনরা এসে কারখানার পাশে অপেক্ষা করছেন হারানো স্বজনদের পেতে। কারখানাটির মালিক সান্তাহার পৌরসভার মেয়র তোফাজ্জল হোসেন ভুট্ট।
নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন- পালোয়ান পাড়ার বাসানের ছেলে রিমন (১৫), ছাতনি গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে বেলাল হোসেন (৫৫), সান্দিরা গ্রামের নাসির উদ্দিনের ছেলে শাহজাহান (২৯), কমলদুগাছী গ্রামের লুৎফর রহমান সিহাব হোসেন (১২)।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্লাস্টিক কারখানায় ওয়ানটাইম প্লেট সামগ্রী তৈরি করা হতো। কারখানার বয়স তিন বছর হলেও অনুষ্ঠানিক চালু করা হয়েছে এক বছর আগে। প্রতিদিনের মতো শ্রমিকরা সকাল থেকে সেখানে কাজ করছিল। দুই শিফটে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করে। দিনে ৩৫ জন ও রাতে ৩৫ জন। হঠাৎ করেই কারখানার ভেতরে পশ্চিম দিকে প্লাস্টিকের কাঁচামাল রাখার জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে মুহূর্তের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কারখানায় আগুনের সূত্রপাত হলে শ্রমিকরা হুড়োহুড়ি করে বের হন। পরে ফায়ার সার্ভিস ইউনিটে সংবাদ দেওয়া হলে নওগাঁ, আত্রাই, রানীনগর, আদমদীঘি, দুপচাচিয়া থানার ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা।
নিখোঁজ শাহজাহানের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতিদিনের মতো সকালে ছেলে কাজে আসছে। দুপুর টিভিতে খবর দেখলাম কারখানায় আগুন লাগছে। আগুনের সংবাদ পেয়ে কারখানায় ছুটে আসছি। ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ধারণা করছি আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
কারখানাটির মালিক সান্তাহার পৌরসভার মেয়র তোফাজ্জল হোসেন ভুট্ট নিহত পরিবারের পাশে থাকবো। বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ১৫-২০ জন শ্রমিক বেরিয়ে যায়। পাঁচজন মারা গেছে। নিখোঁজদের বিষয়ে জানা সম্ভব হয়নি। নিহত পরিবারের পাশে থাকবো।
তিনি আরও বলেন, সংবাদ পেয়ে কারখানায় আসি। কারখানায় ওয়ানটাই প্লেট সামগ্রি তৈরি করা হতো। আগুনে কারখানার কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছি।
নওগাঁ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক একেএম মুরশেদ নিহত পরিবারের পাশে থাকবো। বলেন, সংবাদ পাওয়ার পর নওগাঁ ইউনিটসহ ১২টি ইউনিট বিকেল ৩টার দিকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা এখনো বলা সম্ভব না। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। পাঁচজন শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মরদেহ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। তবে নিহতের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয়নি। ঘটনায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আদমদীঘি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কলকারখানা পরিদর্শকসহ কয়েকজন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুত্র জানি