আশ্রয়ণ প্রকল্পের তৈরি ঘর হাতুড়ি—শাবল দিয়ে ভাঙা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য বিতরণ করা উপহারের ঘর কিছু মানুষ হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে ভেঙে তা গণমাধ্যমে প্রচার করছে। যারা ঘর ভেঙে ছবি দিয়েছে, তাদের নামের তালিকাসহ তদন্ত প্রতিবেদন নিজের হাতে রয়েছে বলে জানান তিনি। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভার সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রায় এক বছর পর প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সভাপতিত্বে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন ৫০ জন কেন্দ্রীয় নেতা। সকল নেতাদের একসাথে দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। । বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সভায় আগামী জাতীয় নির্বাচন, দলকে শক্তিশালী করা, মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা উপজেলার সম্মেলন, নাটোর ও পাবনা জেলার সাংগঠনিক স্থবিরতা সম্মেলন, সংগঠনের বিভিন্ন কাজে এমপিদের বাড়াবাড়ি, করোনায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মানবিক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলকে শক্তিশালী করতে নানা দিক—নির্দেশনা দিয়েছেন।
সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী কতিপয় অসাধু মানুষের মনোবৃত্তিকে ‘জঘন্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো’ আমরা যখন ঠিক করলাম, প্রত্যেকটা মানুষকে ঘর করে দেব। আমি কয়েকটা জায়গায় দেখলাম ঘর, ভেঙে পড়ছে। বিভিন্ন জায়গার এমন ছবি দেখার পর সার্ভে করালাম কোথায় কী হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রায় দেড় লাখ ঘর আমরা বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করে দিয়েছি। কিছু মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে গিয়ে তিনশটি ঘর হাতুড়ি শাবল দিয়ে ভেঙে তারপর মিডিয়ায় ছবি দিয়েছে। এদের নাম—দাম তদন্ত করে সব বের করা হয়ে গেছে। আমার কাছে পুরো রিপোর্ট আছে। তিনি আরও বলেন, গরিবের জন্য ঘর করে দিচ্ছি। ঘরগুলো যে এভাবে ভাঙতে পারে… সেই ছবিগুলো দেখলে, দেখা যায়।
ঘর ভেঙে পড়ার পেছনের কারণ মিডিয়া অনুসন্ধান করেনি অভিযোগ করে সরকার প্রধান বলেন, মিডিয়া এগুলো ধারণ করে প্রচার করে, তারা কিন্তু এটা কীভাবে হলো সেটা দেখে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক জায়গায় যেমন ছয়শ’ ঘর করা হয়েছে, সেখানে প্রবল বৃষ্টিপাতে মাটি ধসে কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ৯টি জায়গায় কিছুটা দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যত্র আমি দেখেছি যে, প্রত্যেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ইউএনও এবং ডিসিসহ সরকারি কর্মচারীদের ওপর এগুলোর তদারকির দায়িত্ব ছিল, যাদের অনেকেই এগিয়ে এসেছেন এ ঘর তৈরিতে সহযোগিতা করার জন্য। অনেকে অল্প পয়সায় ইট সরবরাহ করেছেন। এভাবে সবার সহযোগিতা এবং আন্তরিকতাই বেশি ছিল। কিন্তু এরমধ্যে দুষ্ট বুদ্ধির কিছু (অসাধু চক্র) এবং সেটাই সব থেকে কষ্টকর।
শেখ হাসিনা বলেন, যখন এটা গরিবের ঘর, তখন এখানে হাত দেয় কীভাবে। যাহোক, আমরা সেগুলো মোকাবিলা করেছি। তবে, আমাদের নেতাকর্মীদের এ ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকা দরকার।
এ ধরনের ঘটনা দেখা বা জানার পরে স্থানীয় যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সরজমিনে গিয়ে নিজেরাও তদারকরি করছেন এবং তাকে ছবি পাঠাচ্ছেন এবং সেভাবে কাজ করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সূচনা বক্তব্যের পর সাতজন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তাদের দলীয় রিপোর্ট পেশ করেন। চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দেশের বাইরে থাকায় তিনি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সমস্যা তুলে ধরেন। প্রায় সকলের রিপোর্টেই সংগঠনের নেতাদের সাথে এমপিদের বিরোধ, কমিটিতে এমপিদের পারিবারিক আধিপত্য বিস্তার, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়—স্বজনদের পদ—পদবি দেয়ার প্রচেষ্টা, ত্যাগী নেতাদের দূরে রাখা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নানা সমস্যার বিষয় তুলে ধরেছেন। তাদের বক্তব্যের সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে বিভাগীয় যুগ্ম—সাধারণ সম্পাদকরা কথা বলেছেন। চারজন যুগ্ম—সাধারণের মধ্যে মাহবুব উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম উপস্থিত ছিলেন। আরেক যুগ্ম—সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ভারত থেকে গতকাল দেশে ফিরেছেন তাই বৈঠকে উপস্থিত হননি।
এদিকে বিগত কিছু নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে যারা লিখিতভাবে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। বৈঠকে নাটোর ও পাবনা জেলার সাংগঠনিক স্থবিরতার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সভাপতি—সেক্রেটারি যদি একসাথে কাজ করতে না পারে, তাহলে এর বিকল্প চিন্তা করতে হবে। বিকল্প হলো সম্মেলন। পরে নাটোর ও পাবনা জেলার সম্মেলন যথাক্রমে ৬ ও ৭ নভেম্বর ঠিক করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী এমপিদের বিষয়ে বলেন, নানা কারণে অনেক বিষয় চিন্তাভাবনা করে জয় নিশ্চিতের জন্য অনেককেই এমপি মনোনয়ন দেয়া হয়। তাই বলে এই নয়, এমপি হয়েই তারা সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সমস্যা তৈরি করবেন। সংগঠনের মধ্যে এমপি লীগ তৈরি করা এবং ত্যাগী নেতাদের দূরে রাখার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। কোনো বাড়াবাড়ি করা যাবে না। সংগঠন সংগঠনের মতো চলবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। দীর্ঘ ১২ বছর দল ক্ষমতায় থাকায় কিছুটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। সকল দুর্বলতা কাটিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি বলেন, সংগঠন শক্তিশালী হলে, দেশ উন্নত হলে ষড়যন্ত্রও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সেমিনার করে আগামী নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজে হাতে দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কোন কোন বিষয় ইশতেহারে আনা যায়, এ নিয়ে উপ—কমিটিগুলোকে কাজ করতে হবে। বিদ্রোহী ইস্যুতে তিনি বলেন, ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাবনা পৌরসভা নির্বাচনের বিদ্রোহীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন দলীয়প্রধান।
বৈঠকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অপপ্রচার নিয়ে কথা হয়। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অপপ্রচার বেশি হচ্ছে। অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হবে বলে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা করোনার মধ্যে জনগণের পাশে থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।