১৯৮৬ সাল। আমি উখিয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। সকাল ছয়টা থেকে আটটা মক্তবে আমপারা পড়া। মক্তব ছুটির পর ঘরে এসে পান্তাভাত খেতে খেতে মায়ের গরুর দুধ দোহন শেষ হত। তখন আমার কাজ গরু গুলো সাতআইজ্জা ডোবায় চরতে দিয়ে আসা।
“সাতআইজ্জা” হচ্ছে একটি ডোবার নাম। “সাতআইজ্জা” নাম করণের বিষয়ে মত পার্থক্য আছে।
কেউ বলে, এই ডোবায় বছরে কেবল একবার চাষ হয় এবং মাত্র সাত আরি ধান ফলন হয়।এক আরি সমান ১৪ সের। আবার কারো মতে, শীতকালে এই ডোবার পানি শুকিয়ে গেলে সাত আরি মাছ পাওয়া যেত। তাই এই নাম। নাম যাই হোক শীত ও গ্রীষ্মঋতুতে এই ডোবা গোরু চরার জন্য বেশ উপযোগী। বাড়িতে ৮/১০ টি গোরু ছিল। গোরু সাতআইজ্জা ডোবায় চরতে দিয়ে আমি স্কুলে যেতাম।
মার্চের ২৬ তারিখ মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হবে। ক্লাসে নোটিশ দেওয়া হল- তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর সকল ছাত্রছাত্রী স্কুল ড্রেসে সকাল আটটায় মাঠে থাকবে।আর প্রথম – দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে যাদের বাড়ি মাঠের কাছে তারা যে কোন পোষাকে আসবে। বাধ্যতামূলক নয়। মক্তব বন্ধ।
আমি সকালে মাকে বললাম গরুর দুধ সকাল সকাল দোহন করতে। গরু আজকে বকশিবিলে নিয়ে যাব।
উদ্দেশ্য – মাঠে মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখা। বকশিবিলের অবস্থান হাই স্কুল মাঠের পশ্চিমে। যে মাঠে স্বাধীনতা দিবসের কুচ- কওয়াজ, খেলাধুলা, যেমন খুশি তেমন সাজ ইত্যাদি হয়। আমি গরু গুলো বকশিবিলে চরতে দিয়ে মাঠে চলে এলাম। কুচ- কওয়াজ শেষ। প্রাইমারি স্কুল গ্রুপে আমাদের বিদ্যালয় প্রথম হয়েছে।
মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে বড় প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের একটু সামনে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের দুই লাইনে দাঁড় করিয়েছেন। সবাই থ্রি, ফোর, ফাইভের। আমার ক্লাসের কাওকে দেখছি না। হঠাৎ চোখে পড়ল আমার ক্লাসের করিমকে। কালবিলম্ব না করে আমিও করিমের সামনে ঢুকে পড়লাম। করিম আমার প্রতিবেশী ও সহপাঠী। বর্তমানে স্ব-নামধন্য শিক্ষক ও দেশ বরেণ্য রেফারি। শৈশব থেকেই খুব মেধাবী ও চালাক। তার সামনে দাঁড়ালেও আমাকে বাঁধা দেয়নি।
আমার পরনে লুঙ্গী, গায়ে পুরাতন ছেঁড়া জামা, হাতে আইল্যা ছোঁয়া ( আইল্যা ছোঁয়া মানে- রাখাল ছেলের গোরুর বেত)। খানিকক্ষণ পর দেখি লাইনের প্রথম থেকে প্রত্যেককে একটি করে সমুচা দিচ্ছে। মনে মনে করিমকে ধন্যবাদ দিলাম। আমাকে তার সামনে দাঁড়াতে দেওয়ার জন্য। সহপাঠী বলে সুযোগ দিল।
আমার সামনের একে একে সবাইকে দেওয়ার পর আমাকে দেওয়ার পালা। কিন্তু UNO অফিসের সেই কর্মচারী আমার দিকে চোখ বড় – বড় করে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল- ” তুমি তো ছাত্র নয়, এখানে দাঁড়াইছ কেন? তোমাকে রাখাল বালকের মত দেখাচ্ছে”। এই কথা বলে আমাকে সমুচা না দিয়ে আমার পিছনে দাঁড়ানো করিম থেকে দেওয়া শুরু করল।
আমি সমুচা না পেয়ে থ দাঁড়িয়ে থেকে UNO অফিসের কর্মচারীর হাতের সমুচার ঝুড়ির দিকে অপলক চেয়ে থাকলাম। করিম একটি পেয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে আবার পিছনে গিয়ে লাইনে দাঁড়াইছে। আরেকটি পাওয়ার আশায়। আর আমি একটিও না পেয়ে সবার সমুচা খাওয়ার দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।
লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে করিম আরেকটি পেয়ে প্যান্টের বাম পকেটে ঢুকিয়ে ডানে – বামে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আর পাওয়া যায় কিনা।
অনেকগুলি সমুচা ঝুড়িতে রয়ে গেছে। সমুচা ভর্তি ঝুড়ি প্যান্ডেলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। করিম দুটি পেল অথচ আমি হতভাগার কপালে একটিও জুটল না। করিমের কাছ থেকে একটি চাইলে দেয় কি না। না, দিবে না।যে চার আনার একটি মিটাই (চকলেট) সারাদিন চোষার পর মুখ থেকে বের করে আব কাগজে মুড়িয়ে পরের দিনের জন্য রাখে, তার কাছ থেকে না চাওয়াই ভাল।
প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে এসব ভাবনার সময় আকষ্মিক আবুল ফজল মাস্টার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি পড়া লেখা কর?
– জি করি।
কোন ক্লাসে?
– ক্লাস টু।
ক্লাস টিচার কে?
– ঝুম ঝুম আপা।
সমুচা পাইছ?
– না।
তখন UNO অফিসের সেই কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে আবুল ফজল স্যার বললেন, এই আজ্জল এই শিশুটি কে একটি সমুচা দাও।
আজ্জল – স্যার, ওতো ছাত্র নয়।
-আবুল ফজল স্যার- ছাত্র। যেমন খুশি – তেমন সাজ প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার জন্য রাখাল ছেলে সেজে এসেছে। দাও, একটি দাও।
তখন আজ্জল মিয়া আমাকে একটি সমুচা দিলেন।
এদিকে বকশিবিলে গোরু আনতে গিয়ে দেখি লাইল্যা আর ধইল্যা ( লাল বলদ আর সাদা বৃষ) নাই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কৃষক মছইন্নার জালা(ধানের চারা) খাওয়ার অপরাধে দুইটিকে সুভল্যার খোয়াইলে( সুভল বড়ুয়ার খোয়াড়) দিয়েছে।
আবুল ফজল স্যার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
আজ্জল মিয়া আজকে বেঁচে আছে কি না জানি না। তবে সেদিন আবুল ফজল স্যার এবং আজ্জল মিয়ার কাছ থেকে যে শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম তা আজ অবধি ভুলতে পারি না। সেই শিক্ষাটি সীমিত সামর্থ্য দিয়ে যতটুকু সম্ভব বাস্তব প্রয়োগের চেস্টা করি।
৩৫ বছর পর – – –
২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট। সকাল ৯ টায় জাতীয় শোক দিবসে স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ ও অভিবাদন জানানোর পর আলোচনা সভা শুরুর পূর্বে UNO সাহেব তাঁর অফিসে সবাইকে চা’র নিমন্ত্রণ জানান। সম্মানিত উপজেলা চেয়ারম্যান সহ প্রায় সব বিভাগের কর্মকর্তারা বসলাম। আমার দুই ছেলে আদর ও স্নেহ তৃতীয় সারিতে বসেছে। চা দেওয়ার আগে অফিস কর্মচারী আমার দুই ছেলেকে দুইটি নাস্তার প্যাকেট দিলেন। তারা প্যাকেট খুলে সমুচা বের করে খেতে লাগল। তাদের পিছনে একটি শিশু আদর আর স্নেহের সমুচা খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। শিশুটি এক শিক্ষকের। এই দৃশ্য আমার চোখে পড়তেই বুকে অদৃশ্য এক ধাক্কা অনুভূত হলো। সাথে সাথে কর্মচারীকে ডেকে কানেকানে বললাম পিছনে বসা ঐ শিশুটিকে দ্রুত একটি নাস্তার প্যাকেট এনে দেন। তিনিও তাৎক্ষণিক শিশুটিকে একটি নাস্তার প্যাকেট এনে দিলেন। প্যাকেট পেয়ে শিশুটির নির্মল হাসিতে আমি হারিয়ে গেলাম ৩৫ বছর পূর্বের সেই মাঠে। দীর্ঘ বিলম্বে সমুচা পাওয়ার অনাবিল আনন্দ যে কত মধুর ! তা পুনর্বার উপভোগ করলাম।
### কোন শিশুকে যেন পরনের কাপড় দেখে কিংবা পিতা – মাতার পেশার কারণে পৃথক করা না হয়।
লেখক:
মোহাম্মদ আইয়ুব
অফিসার ইনচার্জ
লালমাই থানা, কুমিল্লা।