কুষ্ঠিয়া ফুলতলা থানার এএসআই সৌমেন কুমার স্ত্রী আসমার অনৈতিক সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি , সৌমেন বার বার নিষেধ করার পরও আসমা শাকিলের সাথে পরকীয়া সম্পর্ক চালিয়ে যায়। ঘটনার দিন আসমা ও শাকিলকে একসাথে কথা বলতে দেখে সৌমেন তার নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে আসমা, শাকিল ও শিশু রবিনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ সৌমেনকে গ্রেফতার করে।
কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড়। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ১১টা। করোনা সংক্রমণের পারদ চড়তে থাকায় চলছিল আঞ্চলিক লকডাউন। ফলে বাজারে মানুষের আনাগোনা কম। রবিবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে অল্পস্বল্প দোকানপাট খুললেও ছিল না ভিড়ভাট্টা। অন্যদিনের মতো বিকাশকর্মী শাকিল মোটরসাইকেলে চেপে কাস্টমস মোড়ে এসে মরিয়ম এন্টারপ্রাইজের সামনে গাড়িটি রাখেন। এর কিছুক্ষণ পর পাশের গলিতে গিয়ে কথিত বান্ধবী আসমা বেগমের সঙ্গে কথা বলছিলেন শাকিল। হঠাৎ গুলির শব্দ। সেখানেই খুলনার ফুলতলা থানার এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) সৌমেন কুমার একে একে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করেন আসমা বেগম (২৫) ও শাকিলকে (৩০)। সৌমেন বাঁচতে দেননি আসমার সাত বছরের শিশুসন্তান রবিন হোসেনকেও। তাদের সবার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সাঁওতা গ্রামে।
এই মর্মস্পর্শী ঘটনার পর সরকারি পিস্তলসহ ঘাতক সৌমেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘটনার সময় শহরের কাস্টমস মোড়ের একটি দোকানের সামনে তিনজন কথা বলছিলেন। সঙ্গে ছিল শিশু রবিনও। হঠাৎ সৌমেন পিস্তল বের করে খুব কাছ থেকে আসমার মাথায় গুলি চালান। গুলি তাঁর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান আসমা।
এর পর শাকিলকেও মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একই কায়দায় গুলি করলে তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় শিশু রবিন ভয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ঘাতক তাকেও ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই এলাকার লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। এক পর্যায়ে স্থানীয় লোকজন সৌমেনকে ধাওয়া করলে তিনি পাশের একটি তিনতলা ভবনে ঢোকার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি আবার পিস্তলে ম্যাগাজিন ঢুকাতে চাইলে জনতা তাঁকে ধরে একটি দোকানে আটকে রাখে।
এরপর কুষ্টিয়া সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে অস্ত্র-গুলিসহ তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, আসমার সঙ্গে সৌমেনের বছরখানেক আগে বিয়ে হয়। এর আগেও আসমার আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। শিশু রবিন আসমার সেই পক্ষের সন্তান। শাকিল ও সৌমেন ছিলেন বন্ধু। আসমার মাধ্যমেই সৌমেনের সঙ্গে শাকিলের সখ্য হয়। সৌমেনও আগে একটি বিয়ে করেন।
সেই ঘরে তাঁর ১৪ বছরের একটি মেয়েও আছে। সৌমেনের বাড়ি মাগুরার শালিখায়। তিনি আগে কুষ্টিয়ার হালসা পুলিশ ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন। এলাকাবাসীর ধারণা, তখনই আসমার সঙ্গে সৌমেনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মণ্ডল অ্যান্ড ফুড অ্যান্ড কনফেকশনারির মালিক ওলিউজ্জামান ওলি বলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে আমি ওই দিকে তাকাতেই দেখি, ওই শিশুটি দৌড়ে আমার দোকানের দিকে আসতে চাইলে খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। এ সময় একজন লোক তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করলেন।
তখন আশপাশের জনতা ওই অস্ত্রধারীকে ধাওয়া দিলে তিনি আরো দুই-তিন রাউন্ড গুলি করেন। এরপর ব্যবসায়ীরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে একজোট হয়ে ঘাতককে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে শুনি, অস্ত্রধারী ঘাতক একসঙ্গে তিনজনকে গুলি করে মেরেছেন।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মরিয়ম এন্টারপ্রাইজের মালিক বিকাশ এজেন্ট সুরুজ আলী বলেন, ‘আমার দোকানের ডানে গলির মধ্যে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনে আতঙ্কে দোকান ছেড়ে সামনের দিকে দৌড় দিই। দূরে দাঁড়িয়ে একজনকে পিস্তল হাতে বাইরে আরো কয়েক রাউন্ড গুলি করতে দেখেছি।’
এদিকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার সরকার জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার পর নারী-শিশুসহ গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে তিনজনকেই মৃত অবস্থায় পান।তাদের মাথাসহ শরীরের অন্য স্থানে গুলি লেগেছে। খুব কাছ থেকে গুলি চালানো হয়। হাসপাতালের মর্গে সবার লাশ রাখা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম জানান, অস্ত্রসহ সৌমেনকে আটক করা হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম জানান, সৌমেন যা করেছে তা একান্তই তাঁর নিজস্ব ও পারিবারিক বিষয়। প্রচলিত আইনে তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সামনে কথা হয় আসমা বেগমের মা ডিম বিক্রেতা হাসিনা বেগম ও ভাই রিকশাচালক হাসানের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘আসমার আগে দুটি বিয়ে হয়েছিল। রবিন তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর ছেলে। সৌমেন আসমার তৃতীয় স্বামী। আমরা শুনেছি, সৌমেনেরও আরেকটি স্ত্রী রয়েছে। এ নিয়ে সৌমেন ও আসমার মধ্যে মনোমালিন্য ছিল।’
একটি সূত্র জানিয়েছে, সৌমেন বিয়ে করলেও আসমা তাঁর প্রতিবেশী শাকিলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, যা সৌমেন মানতে পারেননি। এ কারণেই সৌমেনের সঙ্গে আসমার বিরোধ চলছিল। সূত্রটি দাবি করেছে, আসমার সঙ্গে শাকিলের কোনো সম্পর্ক বা আর্থিক লেনদেনের ঝামেলা থাকতে পারে। আসমা, সৌমেন ও শাকিলের মধ্যে ত্রিমুখী কোনো সম্পর্কের দ্বন্দ্বে এই ট্রিপল মার্ডার হতে পারে।
এদিকে কুমারখালীর সাঁওতা গ্রামে কথা হয় শাকিলের ভাবি লতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসমার সঙ্গে শাকিলের চেনাজানা ছিল। তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ভাই-বোনের মতো। এর বাইরে কোনো গোপন সম্পর্ক ছিল কি না,আমার জানা নেই। তবে সৌমেন কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে এসে জানান, তাঁর স্ত্রী আসমার সঙ্গে শাকিলের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। সে যেন তার সঙ্গে মেলামেশা না করে।’