চট্টগ্রামে মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ৫ বছর পরও তার স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের প্রধান সোর্স মুসার কোনো সন্ধান পায়নি তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মুসাকে গুম করার পেছনে বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি পুলিশ। উল্টো ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও পিবিআইতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
গুম হওয়া কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি- মিতু হত্যার ১৭ দিন পর ২২ জুন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক তার স্বামীকে নগরীর কাঠগড় এলাকা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মুসাকে গ্রেফতারের সময় সাদা পোশাকধারী সিএমপি’র দু’জন ওসিকে চিনতে পেরেছেন বলেও পান্না দাবি করেন। ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করতে পারবেন যে তার স্বামী মুসা কোথায় আছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন,মুসাকে খুঁজে পাওয়া গেলেই মিতু হত্যার সকল রহস্যের জট খুলে যাবে।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর ওআর নিজাম রোড আবাসিক এলাকার প্রবেশ মুখে নিজের ৮ বছর বয়সী ছেলের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে খুন হন মিতু। হত্যাকাণ্ডের পর তার স্বামী তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তখন পুলিশের ধারণা ছিল চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড জঙ্গিরা ঘটিয়ে থাকতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সারাদেশে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামে। দুই সপ্তাহের অভিযানে সারাদেশে পুলিশ সাড়ে ৭ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করে। জঙ্গি সন্দেহে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪ জন নিহত হয়। এরপর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এই হত্যার সঙ্গে বাবুল আক্তারের প্রধান সোর্সসহ ৭ জন সরাসরি জড়িত।
ওই বছরের ২৪ জুন বাবুল আক্তারকে ঢাকায় ডিবি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর কয়েকদিন পর পুলিশের চাকরি থেকে বাবুল সেচ্ছায় অবসর নিয়ে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগদান করেন। এরপর ৫ জুলাই চট্টগ্রামে মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ২ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এ ব্যাপারে মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন শুক্রবার (৪ জুন) বলেন, ঘটনার সময় বাবুল আক্তার খিলগাঁওয়ে তার বাড়িতে ছিলেন।
ওই সময় মোবাইল ফোনে বাবুল আক্তার চট্টগ্রামের এক থানার ওসিকে ফোন দিয়ে বলেন যে মিতু হত্যার সঙ্গে যেই জড়িত থাক, তাকে মাইনাস করে দাও। বাবুল আক্তার যে এই খুনের সঙ্গে জড়িত-এটা জানার পরও কেন প্রতিবাদ করেননি জানতে চাইলে মোশারফ হোসেন বলেন, আমরা তখন বুঝতেই পারিনি যে বাবুল আক্তার এতটা দুর্ধর্ষ। সে হত্যার পরিকল্পনা করে উল্টো শ্বশুরবাড়িতে বসেছিল। পরে যখন বুঝতে পারি যে বাবুল আক্তারই মূল খুনী, তখন আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর পর সেই বিষয়টি আমলে নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে।
দুই পুলিশ কর্মকর্তা কোথায়:
মিতু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কুশীল কামরুল ইসলাম শিকদার মুসার অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বলছে মুসা পলাতক। তবে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি- মিতু হত্যার ১৭ দিন পর ২০১৬ সালের ২২ জুন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক তার স্বামীকে নগরীর কাঠগড় এলাকা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। এর আগে তার স্বামী পতেঙ্গার নুরুন্নবী ড্রাইভারের বাসায় রাত কাটিয়েছিলেন। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ডিবির পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম ও পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন তার স্বামীকে আটক করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম বর্তমানে চট্টগ্রাম পিবিআইতে কর্মরত। আর পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতয়ালি থানার ওসি’র দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও পুলিশ মুসা গুমের সঙ্গে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে আসছে।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড ৷ ২০১৬ সালের ২৪ জুন বাবুল আক্তারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ওই বছরের ২৬ জুন আনোয়ার ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। তারা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলে, কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুছার ‘পরিকল্পনাতেই’ এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানায়, নবী, কালু, মুছা ও তিনি হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেয়। হত্যার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সামনে ছিল মুসা, এরপর আনোয়ার ও একদম পেছনে ছিল সে।
মোটরসাইকেলের পিছন থেকে সে প্রথমে মিতুকে গুলি করে। জিইসির মোড়ে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা নবী তার বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পুরো সময়টা বাবুল আক্তারের ছেলেকে আটকে রেখেছিল মুসা। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা চলে যায়। পরে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই আসামি নূরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মুছাসহ দুই জন আসামী গুম হয়ে গেছে। এই মামলায় বর্তমানে ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী। নবী, কালুসহ ৩ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
বাবুলের শ্বশুরের মামলা দায়ের
দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর তদন্তের পর গত ১২ মে বাবুলের দায়ের করা মিতু হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন চট্টগ্রামের আদালতে দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রতিবেদনে মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বিষয়টি অবহিত হয়ে একইদিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে নতুন একটি হত্যা মামলা করেন মিতুর পিতা মোশাররফ হোসেন।
মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্র্তা গায়ত্রী অমর সিংয়ের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বাবুল আক্তার। বিষয়টি জানার পর মেনে নিতে পারেননি মিতু। এর জের ধরে বাবুল ও মিতুর দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে গায়ত্রীর পরামর্শে মিতুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে বাবুল।এরই ধারাবাহিকতায় মুসাসহ কয়েকজন বাবুল আক্তারের নির্দেশে মিতুকে হত্যা করে। মিতুর বাবার মামলায় পুলিশ সেদিনই বাবুলকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। এরপর তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গত সপ্তাহে তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফেনী জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।
গায়ত্রী কোথায়
পিবিআই জানতে পেরেছে বাবুল আক্তারের কথিত বান্ধবী গায়ত্রী অমর সিং বর্তমানে ইউরোপের একটি দেশে জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর এ কর্মরত। তার অবস্থান জানতে চেয়ে এবং মামলার প্রয়োজনে তার সাথে কথা বলার অনুমতি চেয়ে গত সপ্তাহে ইউএনএইচসিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা জানান। তিনি বলেন, আমরা গায়ত্রী অমর সিংয়ের অবস্থান জানার চেষ্টা করছি।
তাকে পাওয়া গেলে তার সাথে সরাসরি অথবা ভার্চুয়ালি কথা বলবো। তবে গায়ত্রী এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফ্যাক্টর নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, গায়ত্রীকে পাওয়া না গেলেও মামলার স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব পড়বে না। তার সাথে বাবুলের হয়তো বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু মিতু হত্যায় গায়ত্রীর জড়িত থাকার প্রমাণ এখনো দেখছি না।