অভিনব প্রতারণা তাও আবার রাজকীয় স্টাইলে। লক্ষ্য সমাজের বিত্তবানদের অর্থ হাতিয়ে নেয়া। এই জন্য প্রতারণায় সক্রিয়ভাবে জড়িত একাধিক সদস্যের একটি দল। যে দলের নাম ‘রয়েল চিটিং ডিপার্টমেন্ট বা আরডিসি’। দলের সদস্যরাই দিয়েছে এমন অভিনব নাম।
আরডিসি’র সদস্যরা প্রথমে সমাজের বিত্তবানদের টার্গেট করতে বিভিন্ন বাড়িতে যায়, অফিস ভাড়া নেয়ার নাম করে। এরপর বাড়ির মালিক ও তার পরিচিতদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে ধাপে ধাপে প্রতারণার জাল বিছাতে থাকে দলের সদস্যরা।
টার্গেট ব্যক্তিদের প্রস্তাব দেয়া হত কোটি টাকার ব্যবসায় অংশীদারিত্বের কিংবা মোটা বেতনের লোভনীয় চাকরি। যে চাকরিতে বেতন আবার যেনতেন নয়, সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে শুরু। রাজকীয় এই চিটার বা প্রতারক দলের চালচলনেও ছিলো আভিজাত্য। প্রতারণার ফাঁদ পাততে তারা রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নিত অফিস ভাড়া। ফ্ল্যাট নয়, অফিস হিসেবে ভাড়া নেয়া হতো পুরো বাড়ি। আর নিজেদের পোশাক পরিচ্ছেদে ও অন্যদের ন্যায় অফিসের সাজ-সজ্জায়ও থাকতো আভিজাত্যের প্রকাশ। দেশের বিত্তবান, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা কিংবা বড় ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে চলতো তাদের প্রতারণার চাল।
কখনো কখনো তাদের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন ভাড়া নেয়া অফিসের বাড়ির মালিকও। সুযোগ বুঝে ছলচাতুরীর মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তিকে নেয়া হয় তাদের অফিসে। তার সামনেই চলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন তাও থাকত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সাজানো ব্যক্তিদের দিয়ে। ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতি আস্থা তৈরি করে টার্গেট করা বিত্তবানদের দেয়া হত ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রস্তাব। আর বিনিয়োগ হওয়া মাত্রই রাতারাতি অফিস ফেলে কেটে পড়ত পুরো প্রতারক দল।
আরডিসি’র সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে চালিয়েছে তাদের এমন রাজকীয় প্রতারণা। দলের কোনো কোনো সদস্যকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হত বিদেশি ব্যবসায়ী হিসেবে। আর নিজেদের কখনো অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কখনো বড় ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচয় দিত তারা। রাজধানীতে এই আরডিসি’র হাতে কোটি কোটি টাকা খুঁইয়েছেন সাবেক সচিবসহ বেশ কয়েকজন বিত্তবান ব্যবসায়ী। গত ২০ থেকে ২৫ বছর বছর ধরে আরডিসি চালিয়ে গেছে তাদের রাজকীয় এই প্রতারণা। বেশ কয়েকটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতারক দলকে ধরতে মাঠে নামে প্রশাসন।
অবশেষে রাজধানীর গুলশান, ভাটারা ও ভাষানটেক থানা এলাকায় গত ১৪ ডিসেম্বর (সোমবার) বিকাল ৪টা থেকে রাত পৌঁনে ১০টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এই ৫ প্রতারককে গ্রেফতার করে ডিবির গুলশান জোনাল টিম।
শুক্রবার (১৮ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগ থেকে আরডিসি’র এই পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের বিষয়ে গণমাধ্যমকে অভিহিত করা হয়। গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগের বর্ণনায় প্রায় একই ধরণের কায়দায় প্রতারণার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। এরপর ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী প্রতারক দলটির ভাড়া নেয়া অফিসগুলোতে তদন্ত শেষে তাদের শনাক্ত করা হয়। পরে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের টিমের অভিযানে আরডিসি’র পাঁচ সদস্য শহিদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান (৫২), মোহাম্মদ আলী (৫৯), সুমন আহমেদ (৩৩), তোফায়েল হোসেন রতন (৬০) ও এম আজাদ (৪৮) গ্রেফতার হয়।
এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত একটি ব্রিফকেস, ফাইলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া ৮৫ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।
তিনি জানান, বিগত প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতারকরা অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে আসছিল। এভাবে তারা সাবেক সচিবসহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। তাদের অন্য সহযোগীদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মশিউর রহমান বলেন, গ্রেফতাররা সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা প্রতারণা করার জন্য প্রথমে ছদ্মনাম ধারণ করে। ভালো পোশাক এবং চালচলন দেখিয়ে অভিজাত এলাকায় বাসা অথবা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। গর্জিয়াস আসবাবপত্র দিয়ে অফিস সাজায়। একটি গ্রুপ বিভিন্ন পেশাজীবীকে টার্গেট করে। টার্গেটের শীর্ষে থাকে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তা অথবা কোনো বড় ব্যবসায়ী যারা প্রতিনিয়ত টাকা-পয়সা লেনদেন করেন। অনেক সময় তারা বাসা ভাড়া নেয়ার নাম করে কারও বাড়িতে যায়। কখনও কখনও বড় ধরনের ব্যবসার কথা জানিয়ে সেখানে বিনিয়োগ করার জন্য লোকজনকে আমন্ত্রণ জানায়। ভাড়া করা অফিসে টাগের্ট লোকদের নেয়া হয়। একপর্যায়ে নানা ধরনের ছলচাতুরীর মাধ্যমে ভিকটিমদের বিমোহিত করা হয়।
ডিসি মশিউর রহমান আরও জানান, প্রতারকদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশি বড় ব্যবসায়ী সাজে। যাদের বিহারি বা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রাচি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে তারা। অনেক সময় আবার বলে থাকে জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চারে বড় কোনো ব্যবসা করবে। এ ধরনের প্রলোভনে পা ফেলে অনেক সময় ভিকটিম সর্বস্ব হারায়। প্রতারকরা টাকা নেয়ার পরপরই তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। অফিস ত্যাগ করে লাপাত্তা হয়। এভাবে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের নজরে এসেছে। গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগ ইতোমধ্যে আটটিরও বেশি অফিস চিহ্নিত করে এবং অভিযান পরিচালনা করে। অল্প কিছুদিন আগেই একাধিক গ্রুপকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
বিভিন্ন থানার একাধিক মামলা সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় এক মামলায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আরেক মামলায় ১৪ লাখ টাকা, ভাটারা থানার এক মামলায় ৫৬ লাখ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। মামলাগুলো করার পর থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি এর ছায়া তদন্ত করে। তদন্তের এক পর্যায়ে ভয়ংকর এ চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ।
গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, লোভে পড়ে নির্বুদ্ধিতা থেকে মানুষ তাদের ফাঁদে পা দেয়। পরে ধরা খেয়ে যায়। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।