বাংলাদেশে এখন ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি অনেকের কাছে এগুলো অর্থ আয়ের জন্য একটি মাধ্যম হিসাবে গড়ে উঠছে। বাংলাদেশের কোন কোন কনটেন্ট নির্মাতা ইউটিউব এবং ফেসবুক থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করছেন।
বাংলাদেশের তরুণদের অনেকেই এখন পেশাদারিভাবে ইউটিউব এবং ফেসবুকের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন। এসব ভিডিও দেখা হচ্ছে অসংখ্যবার।
বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার রাশেদুজ্জামান রাকিব। ইউটিউবে তিন বছরে তার আরএনএআর চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। তিনি মূলত চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে মজাদার ভিডিও তৈরি করেন। আর কিটো ভাই নামে পরিচিত মাশরুর ইনান এক বছরেই সাবস্ক্রাইবার পেয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ।
ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে টাকা আয়ের উপায়:
একটি চ্যানেল তৈরি: ইউটিউবের ক্ষেত্রে প্রথমেই একটি চ্যানেল তৈরি করতে হবে। জিমেইল ব্যবহার করে ইউটিউবে লগইন করে চ্যানেল তৈরি করা যায়। ফেসবুকে নিজস্ব একটি পেজ তৈরি করতে হবে, যেখানে আপনার কনটেন্টগুলো প্রদর্শিত হবে। এসব করার জন্য আপনার বয়স অন্তত ১৮ বছর বা তার বেশি হতে হবে।
কনটেন্ট বাছাই ও তৈরি: ইউটিউবার রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, কনটেন্ট বাছাই করার ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে যেন সেটা ব্যতিক্রমী, আলাদা ধরণের কিছু হয়। কারণ এখন অসংখ্য মানুষ ইউটিউব এবং ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করছেন, প্রতিযোগিতা অনেক। সেখানে ব্যতিক্রমী কিছু না হলে মানুষ আগ্রহী নাও হতে পারে। ”নিয়মিত কনটেন্ট আপলোড করতে হবে, ধারাবাহিক থাকতে হবে। টার্গেট থাকা উচিত প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি ভিডিও আপলোড করা।”
এজন্য যেমন শিক্ষামূলক পাতা, প্রযুক্তি সম্পর্কে নানা তথ্য, মজাদার ভিডিও, গেম নিয়ে ভিডিও, বাচ্চাদের খেলনা, খাওয়া-দাওয়া, বই বা চলচ্চিত্রের রিভিউ ইত্যাদি তৈরি করা যায়। ভিডিওগুলো হতে হবে পরিষ্কার, শব্দ ভালোভাবে শোনা যাবে, সম্পাদনার কাজটি ভালো হতে হবে। সেই সঙ্গে টাইটেল, নানা ধরণের শব্দের ব্যবহার ঠিক থাকতে হবে। তবে ইউটিউব বা ফেসবুক, যে মাধ্যমের জন্যই কনটেন্ট তৈরি করা হোক না কেন, সেগুলোর যেগুলোয় অন্য কারো কপিরাইট থাকতে পারবে না।
মনিটাইজেশন: ইউটিউব বা ফেসবুকে কোন ভিডিও আপলোড করলেই সেটা থেকে টাকা আসবে না। সেজন্য আপনার একাউন্টটি মনিটাইজেশন করতে হবে। এটা হচ্ছে ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে অর্থ আয়ের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়া। তবে চাইলেই এই মনিটাইজেশন করা যায় না। যেমন ইউটিউবের ক্ষেত্রে আপনাকে ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে অংশ নিতে হবে।
সেক্ষেত্রে: চ্যানেলের অন্তত ১০০০ সাবস্ক্রাইবার থাকবে হবে। সর্বশেষ ১২ মাসে চ্যানেলের ভিডিও মিলে অন্তত ৪০০০ ঘণ্টা দেখার রেকর্ড থাকতে হবে। ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে একটি গুগল অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট সংযুক্ত থাকতে হবে। এসব শর্ত পূরণ করা হলে আবেদন করার পর আপনি ইউটিউব থেকে বিজ্ঞাপন পেতে শুরু করবেন।
ইউটিউব সিপিএম বা কস্ট পার মাইলস/থাউজ্যান্ডের হার এবং সিপিসি বা কস্ট পার ক্লিকের ভিত্তিতে টাকা দেয়। কনটেন্ট, ভিউ ইত্যাদির ভিত্তিতে সিপিএম রেটও ওঠানামা করে।
ফেসবুকের জন্য: মনিটাইজেশন পেতে হলে ফেসবুকের পাতায় আগে থেকেই বেশ কিছু ভিডিও আপলোড করতে হবে। সব ভিডিও অন্তত তিন মিনিটের লম্বা হতে হবে এবং ভিডিও-র অন্তত একমিনিট ধরে দেখার রেকর্ড থাকতে হবে। গত ৬০ দিনের ভিডিওগুলো মিলে অন্তত ৩০ হাজার ভিউ থাকতে হবে। ফেসবুক পাতার অন্তত ১০ হাজার ফলোয়ার থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশ ও ভাষা ফেসবুকের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বাংলাদেশ ও ভাষা ফেসবুকে সমর্থন করে।
পেজে এমন কোন ছবি বা ভিডিও, কনটেন্ট থাকতে পারবে না, যেগুলো ফেসবুকের নীতিমালা ভঙ্গ করে। বিশেষ করে কনটেন্ট এমন হতে হবে যেন সবাই দেখতে পারে।
এগুলো করা হলে আপনার ফেসবুক পাতাটি অ্যাড ব্রেকের জন্য উপযুক্ত হবে। তখন কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন সংযুক্ত করে আবেদন করলে ফেসবুকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার কনটেন্ট যাচাই বাছাই করে দেখবে। বিশেষ করে দেখা হবে এগুলো আসল নাকি কোথাও থেকে নকল করা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ফেসবুক মনিটাইজেশন খুলে দেবে, আপনি বিজ্ঞাপন পাবেন এবং সেটা পছন্দমতো স্থানে বসাতে পারবেন।
আরএনএআর ইউটিউব চ্যানেলের রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, ফেসবুকে অনেক পাতা আছে লাখ লাখ লাইক, কিন্তু তারা মনিটাইজেশন পায়নি। আবার কোন পাতা হয়তো ত্রিশ হাজার লাইক নিয়ে মনিটাইজেশন পেয়েছে। এটা আসলে নির্ভর করে তারা ফেসবুকের শর্তগুলো কতোটা ভালোভাবে পূরণ করতে পারছে।
ইউটিউব-ফেসবুকের বিজ্ঞাপন বেশি পাওয়ার উপায়: বিজ্ঞাপন পাওয়া না পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যানেল বা পেইজের নিজেদের করার কিছু নেই। কনটেন্টের ধরণ, সেটা দেখার প্রবণতা, দেশ ইত্যাদি বিচার ইউটিউব বা ফেসবুক স্বয়ংক্রিয় ভাবে বিজ্ঞাপনগুলো দেবে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিজ্ঞাপন ইউটিউবকে দেয়। ইউটিউব আবার সেসব পণ্যের সম্ভাব্য বাজার বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে বিজ্ঞাপন সরবরাহ করে।
চ্যানেলের মোট কতজন সাবস্ক্রাইবার রয়েছেন, সেটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, যদি তারা চ্যানেলটি নিয়মিত না দেখেন। কারণের চ্যানেলের আয় নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের ওপর। চ্যানেলের ভিউ যতো বাড়বে, চ্যানেলটি ইউটিউব থেকে ততো বেশি বিজ্ঞাপন পেতে শুরু করবেন আর আয় ততো বাড়বে।
রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, ইউটিউব বিডি আসার পর এ ধরণের কনটেন্ট থেকে আয়ের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আগে দেখা যেতো বাংলাদেশের কনটেন্টের এক লাখ ভিউ-র জন্য ২৫ ডলারের মতো পাওয়া যেতো, এখন সেটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
তিনি বলছেন, ইউটিউবের নিয়ম অনুযায়ী, আট মিনিটের কম ভিডিওতে যে পরিমাণ অর্থ আসে, আট মিনিটের বড় ভিডিওতে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ পাওয়া যায়। ফেসবুকেও তিন মিনিটের বড় ভিডিওগুলোয় বেশি অর্থ আয় হয়। একমিনিটের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, তবে তার অর্থমূল্য কম।
একই ভিডিও একই সঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিউবে শেয়ার করা যায়, সাধারণত সব ইউটিউবার এটা করে থাকেন। সেখানে মানুষ কতটা দেখছে, কতক্ষণ ধরে দেখছে, এর ওপর বিজ্ঞাপন বাড়ে বা কমে।
ইউটিউব থেকে আয়ের ব্যাপারে রাশেদুজ্জামান রাকিব একটি ধারণা দিয়ে বলছেন, ১০ মিনিটের একটা ভিডিও যদি গড়ে ৫/৬ মিনিট করে দেখা হয়, তাহলে একলক্ষ ভিউ হলে ১৩/১৪ হাজার টাকা আয় হতে পারে। তবে আট মিনিটের নীচে হলে আয় অর্ধেক হয়ে যাবে।
কিটো ভাই নামে পরিচিত মাশরুর ইনান বলছেন, ইউটিউব-ফেসবুকে যে ভিডিও মানুষ যতো বেশি দেখবে, সেটা দিয়ে ততো আয় হবে। ফলে এখন দেখা যায় অনেকেই নানা ধরণের ভ্লগিং (ভিডিও ব্লগিং) করছেন, নানা বিষয় নিয়ে রিভিউ বানাচ্ছেন।
ফেসবুকে নিজের পাতার বিজ্ঞাপন বা বুস্টিং করা যায়, বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ারের মাধ্যমে লাইক বা জনপ্রিয়তা বাড়ানো যায়। এভাবে যতো বেশি মানুষ ভিডিও দেখবে, আপনার আয়ও ততো বাড়বে।
বাংলাদেশের একজন ভ্লগার রাবা খান বলেছেন, “আপনার যেটা থাকা দরকার সেটা হল ক্রিয়েটিভিটি, মোবাইলটা ইউজ করতে জানা, ভিডিও এডিট করতে জানা, কোনটা ভাইরাল হবে, কোনটা হবে না সেটা বোঝা, মানে মার্কেটটাকে বোঝা। ব্যাস এতোটুকু থাকাটাই যথেষ্ট।”
“ক্রিয়েটিভ যারা আছেন তাদের জন্য এটা খুব ইজি। এবং চাইলেই তারা ফেসবুকে কন্টেন্ট আপলোড করে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারে। আর এর জন্য সব সময় বড় ধরণের ইনভেস্টমেন্টেরও প্রয়োজন হয় না। এই আমার কথাই ধরেন। আমি শুধুমাত্র আমার স্মার্ট ফোন আর একটা লাইট ব্যবহার করি। এটাই আমার লাইফটাইম ইনভেস্টমেন্ট।”
দেশি স্পন্সর নেয়া: কিটো ভাই নামে পরিচিত মাশরুর ইনান বলছেন, আমাদের আয়টা এখন দুইভাবে আসে। একটা ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে সরাসরি টাকা পাই। আরেকটা হচ্ছে স্পন্সরশিপ।
তিনি বলছেন, ”করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর অনেক প্রতিষ্ঠান আর প্রচলিত ফর্মে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন না। এখন যাদের অনেক বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে, তখন তারা তাদের স্পন্সর করেন। তখন আমরা হয়তো তাদের কোন পণ্য আমাদের ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরি। এভাবে সরাসরি স্পন্সরদের কাছ থেকে অর্থ আয় করা যাচ্ছে।”
তিনি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
কীভাবে অর্থ হাতে পাওয়া যাবে: ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে পাওয়া অর্থ বের করাকে বলে পেআউট। ফেসবুকের মনিটাইজেশন চালু করার সময় ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে হয়। একটি নির্দিষ্ট ভিউ হওয়ার পর প্রতিমাসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই একাউন্টে অর্থ জমা হয়। এটা পেপ্যালের মাধ্যমেও তোলা যায়। তবে ইউটিউবের ক্ষেত্রে অন্তত ১০০ ডলার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একশো ডলারের বেশি হলে সেটা গুগল অ্যাডসেন্স ব্যবহার করে নিজের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা যায়।
বাংলাদেশে এখনো ইউটিউবে বা ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা বা নিয়মকানুন নেই। তবে আইনবিরোধী কিছু করা হলে সেটা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় পড়তে পারে।
ইউটিউব-ফেসবুক চ্যানেলের জন্য যা যা দরকার: রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, এসব ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আসলে তেমন কিছুই লাগে না। দরকার পরিকল্পনা, ভালো একটা মোবাইল ফোন আর কনটেন্ট। ”একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যেন ভিডিও কোয়ালিটি ভালো হয়। মানুষ সব কিছুই দেখতে পছন্দ করে। আমার তো মনে হয় কিছুদিন পরে সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেস হয়ে উঠবে ইউটিউব। মানুষ যা দরকার হবে সব ইউটিউবেই খুঁজতে যাবে। ইউটিউবাররা বলছেন, ভিডিও ও ফটো এডিটিং সফটওয়্যারে দক্ষতা এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা এনে দেয়।
যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে: রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, ”যে চ্যানেলই তৈরি করা হোক না কেন, সেখানে স্বকীয়তা থাকতে হবে, অন্যরা যেন সেই চ্যানেলটিকে আলাদা করতে পারে। যেসব কনটেন্ট আপলোড করা হচ্ছে, সেটা নিয়ে যেন কপিরাইটের কোন ঝামেলা না থাকে। কারণ কপিরাইট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো চ্যানেলটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।” সূত্র: বিবিসি