একসময় দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ ছিল রক্তাক্ত। লুটতরাজ, জিম্মি, অপহরণ ও খুন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এসব অপরাধের নেপথ্যে ছিল বিভিন্ন চরমপন্থি দল। আগের তুলনায় এসব অপরাধ কমে এলেও এখনও মাঝেমধ্যে চরমপন্থিদের উৎপাতের কথা শোনা যায়। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এমএল, জনযুদ্ধ, সর্বহারাসহ ১৪টির বেশি চরমপন্থি দলের পলাতক সদস্যরা এখনও সক্রিয় উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে। পলাতক থেকেই তারা সাধারণ মানুষের কাছে চাঁদাবাজি করছে।
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল পাবনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একযোগে ৫৯৫ জন চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করে। এবার আরও ৩২৩ চরমপন্থি সদস্যকে আত্মসমর্পণ করার উদ্যোগ নিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব)। আগামী ২১ মে সিরাজগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তারা। এ সময় চরমপন্থিদের পক্ষ থেকে দুই শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (১৬ মে) চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বৈঠকে চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা, আইনি সহায়তা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা-সংক্রান্ত বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আত্মসমর্পণের পর চরমপন্থিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা করা হবে। হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়া অন্যান্য মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও আইনি সহযোগিতা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, র্যাব-১২-এর তত্ত্বাবধানে এদিন সিরাজগঞ্জ স্টেডিয়ামে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলাসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থি দলের ৩২৩ সদস্য আত্মসমর্পণ করবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও উপস্থিত থাকবেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক (মিডিয়া) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শুরু থেকেই র্যাব চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে আসছে। র্যাবের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে চরমপন্থি বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ অনেক সদস্যকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ৫৯৫ চরমপন্থি সদস্য
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ৫৯৫ চরমপন্থি সদস্য
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও জানান, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ধারাবাহিক অভিযানে পালিয়ে থাকা চরমপন্থি দলগুলোর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে চায়। অপরাধ জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া এসব চরমপন্থির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে র্যাব। চরমপন্থিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ২০২০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে র্যাব।
র্যাব জানায়, চরমপন্থিরা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র হামলা, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। তাদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রয়েছে এক বা একাধিক মামলা। র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে তারা দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। চরমপন্থিদের অনেক সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও গ্রেফতার হওয়ায় স্বাভাবিক পেশায় ফিরতে পারছিল না। এবার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তারা অপরাধ জীবন ছেড়ে স্বাভাবিকভাবে সমাজে বসবাস করতে পারবে।
আত্মসমপর্ণ করা চরমপন্থি সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে র্যাব জানায়, তাদের আর্থিকভাবে সচ্ছল করার জন্য বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসিত করা হবে। ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলের ৩০টি সর্বহারা পরিবারের নারী সদস্যদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার জন্য ‘উদয়ের পথে’ নামক একটি পাইলট প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। ভূমিহীনদের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য জমি বরাদ্দের পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন চরমপন্থি দলের নেতা ও সদস্যদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গরুর খামার, পোলট্রি ফার্ম, মাছ চাষ, চায়ের দোকান, ভ্যান-রিকশা, সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক পেশায় পুনর্বাসন করা হবে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, অপরাধ নির্মূলের জন্য দুনিয়াজুড়েই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি অপরাধীদের সুপথে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চরমপন্থিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চলছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও জানান, জঙ্গিবাদ নির্মূলের ক্ষেত্রেও আভিযানিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আত্মসমর্পণের সুযোগ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট জঙ্গিদের সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করছে র্যাব। ইতোমধ্যে ‘নবদিগন্তের পথে’ শীর্ষক র্যাবের ডি-রেডিক্যালাইজেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক বিপথগামী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে সাধারণ জীবনে ফিরে এসেছে। আত্মসমর্পণ-পরবর্তী তাদের পুনর্বাসনের লক্ষে র্যাব কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের (ট্রাক্টর, গবাদি পশু, ফার্মেসি) সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
র্যাব জানায়, এর আগে সুন্দরবন, কক্সবাজার, মহেশখালী ও বাঁশখালী অঞ্চলের ৫০টি দস্যু বাহিনীর ৪০৫ সদস্যকে সাড়ে ৬০০ অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করায় র্যাব। আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের যে প্রক্রিয়ায় পুনর্বাসন করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়াতেই চরমপন্থিদেরও পুনর্বাসন করা হবে। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে র্যাবের মাধ্যমে জলদস্যু পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে ১০২টি ঘর, ৯০টি মালামালসহ মুদি দোকান, ২২৮টি গবাদি পশু, ১২টি মাছ ধরার নৌকা ও জাল, ৮টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা দেওয়া হয়েছিল।