পাচারের জন্য নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করা ‘সোহাগ ড্যান্স ট্রুপ’কে ব্যবহার করে তরুণীদের সংগ্রহ করতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪ তরুণীকে দুবাইয়ে আজম খাঁনের ড্যান্স বারে পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, ইভানের ড্যান্স ক্লাবটি মিডিয়া অঙ্গনে সুপরিচিত। একারণে নৃত্য শিখতে আসা তরুণীরা তার ওপর আস্থাশীল ছিল। এই সুযোগটিই কাজে লাগাতো ইভান। উচ্চ বেতনে ড্যান্স বারে নাচের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচারের মূল হোতা আজম খানের হাতে তুলে দিতো সে। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইভান ৪ জনকে দুবাই পাঠানোর কথা স্বীকার করলেও সিআইডির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন ইভান আরও অনেক তরুণীকে দুবাই পাচার করেছে। একারণে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা বলেন, লালবাগ থানায় মানবপাচার আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলায় দুবাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আজম খাঁনসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দুজন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ইভান তাদের নারী সংগ্রহ করে দিতো বলে উল্লেখ করে। সেই সূত্র ধরেই ইভানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৪ জন তরুণীকে দুবাইয়ে পাচার করার সুনির্দিষ্ট তথ্য আমরা পেয়েছি। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি সে আরও কত জন তরুণীকে পাচার করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাসিন্দা আজম খাঁন বছর কয়েক আগে দুবাই গিয়ে মানব পাচারকারী শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। মানবপাচার করে আয়কৃত অর্থ দিয়ে সে দুবাইয়ে একাধিক ড্যান্স বার, চার তারকা ও তিন তারকা মানের হোটেল পরিচালনা করতো। ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার নামে এসব হোটেল ও বারে বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার করে আটকে রেখে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করা হতো। সম্প্রতি দুবাই পুলিশ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করার পর সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়। পরে আজম খানকে দুবাই ছাড়তে বাধ্য করা হয়। দেশে আসার পর গত ১২ জুলাই দুই সহযোগীসহ আজম খাঁনকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আজম খাঁন ও তার সহযোগীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তার হয়ে অনেক লোকজন নারী পাচারের কাজ করতো। গত কয়েক বছরে তারা সহস্রাধিক নারীকে দুবাইয়ে পাচার করেছে। মূলত তারা দুবাইয়ে আজম খানের ড্যান্স বারে নাচার চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কিশোরী ও তরুণীদের টার্গেট করে পাচার করতো। ইভান ছিল বাংলাদেশে তার অন্যতম একজন ‘নারী কালেক্টর’। ইভানের ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে বিভিন্ন করপোরেট শোতে মিডিয়া জগতের অনেক সেলিব্রিটিরা অংশ নিত। একারণে মিডিয়ায় তার পরিচিতি বেশি। অনেক উঠতি বয়সী তরুণীরা তার ড্যান্স ক্লাবে নাচ শিখতে ও তার ক্লাবের হয়ে নাচের শোতে অংশ নিতে আসতো। এই সুযোগে সে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও উচ্চভিলাসী তরুণীদের টার্গেট করতো। মাসে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকার আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুবাইয়ের বিভিন্ন ড্যান্স বারে কাজ করার প্রলোভন দেখিয়ে দুবাইয়ে আজম খাঁনের কাছে পাচার করে দিতো।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, ড্যান্স বারে নাচার জন্য দুবাইয়ে আজম খাঁনের হোটেল ও বারে বাংলাদেশ থেকে তরুণীদের নিয়ে গেলেও তাদের কোনও পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। হোটেল ও বারে দেশি-বিদেশি গ্রাহকদের সঙ্গে যৌনকর্মে বাধ্য করা হতো। ইভান এই চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আজম খাঁনের কাছ থেকে প্রচুর অর্থও নিয়েছে। তার অবৈধভাবে আয় করা অর্থের বিষয়েও খোঁজ-খবর করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গুলশানের নিকেতনের নিজ ড্যান্স ক্লাবের অফিস থেকে ইভান শাহরিয়ার সোহাগকে গ্রেফতার করে সিআইডি। শনিবার তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে শুনানি শেষে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। ২০১৭ সালে ‘ধ্যাততেরিকি’ নামের একটি চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনা করে ৪২ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার পেয়েছিল সে।