প্রফেসর আনু মুহাম্মদ বলেছেন, আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে নয়, উন্নয়নের তাণ্ডবে আছি। শ্বাস নিতে পারব না, পানি খেতে পারব না, পথ চলতে পারব না, শিশুরা নড়াচড়া করতে পারবে না এবং বন্দিদশায় থাকবে। আমাদের যা যা সম্পদ সব বেদখল হয়ে যাবে। দেশের মানুষ উন্নয়নের ‘মহাসড়কে’ নয়, উন্নয়নের ‘তাণ্ডবে’ আছে।
শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) আয়োজিত ‘সর্বজনের অধিকার: পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত বেসরকারিকরণ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সবার ওপর সার্বক্ষণিক বোঝা উন্নয়ন নয়। একটা সহজ পথ এগুলোকে উন্নয়ন বলে চালানোর, সেটা হলো জিডিপি। জিডিপি উন্নয়নের ‘খুব বিভ্রান্তিকর পরিমাপক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের জিডিপি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কালকেও বাড়ল। শ্রীলঙ্কার জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল। অনেক দিক থেকে তারা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল। জিডিপি বৃদ্ধির সাথে জনগণের সামর্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষকে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ফেলে জিডিপি বাড়ানো যায়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রসঙ্গ টেনে আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশ সরকার ভাগ্যবান যে শ্রীলঙ্কার মত ঘটনা তাদের একটা সিগন্যাল দিচ্ছে। নয়তো সরকার কোনো রকম বিচার বিবেচনা ছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিচ্ছিল। চায়না, বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে সমানে লোন নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে আরেকটা লোন নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল, সেটা হল সভরেইন লোন। যেটা শ্রীলঙ্কাকে বেশি মাত্রায় ডুবিয়েছে। যার সুদ খুব বেশি এবং দ্রুত পরিশোধ করতে হয়। শ্রীলঙ্কা এ ধরনের লোন বেশি নিয়েছিল বড় প্রজেক্ট করতে গিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির দুর্দশা বাংলাদেশকে ‘থামার’ মত চাপ দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন বলা হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে লোন নেওয়া হবে না। তার মানে এতদিন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ঋণ নিয়েছিল।
এখন হঠাৎ করে হুঁশ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটা আশীর্বাদ। কর্তৃত্ববাদী শাসন চালালে এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প নিলে কী পরিণতি হয়, তার একটা দৃষ্টান্ত শ্রীলঙ্কা। এ সিগন্যাল গ্রহণ করতে হলে উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা বদলাতে হবে। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, এখন উন্নয়ন মানে কেনাকাটা নির্মাণ ও সর্বজনের সম্পদকে প্রাইভেটাইজড করা, নদী নালা খাল বিল উন্মুক্ত স্থান সব।
সাংবাদিক-লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, আজ যে সরকারের ও প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নাই- এটার কারণ শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী বা সরকার না। এটার কারণ যারা জবাবদিহি করার কথা, তারা যদি প্রশ্ন না করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের ঘটনা তো আপনারা দেখেন। যারা যায় তারা যদি প্রশ্ন করার বদলে প্রশস্তি করতে থাকে। সারাক্ষণ তোয়াজ করতে থাকে। বুদ্ধিজীবী-লেখক যারা, যাদের প্রশ্ন করার কথা- তারা যদি সারাক্ষণ তোয়াজ করতে থাকে! পত্রিকায় কলাম মানে যদি হয় সমানে প্রধানমন্ত্রীর স্তুতি করা, তাহলে জবাবদিহি কীভাবে হবে? জবাবদিহির অভাব তখনই তৈরি হয়, যখন সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ববাদ তৈরি হয় এবং তাকে প্রশ্ন না করার মত বুদ্ধিজীবীদের আধিপত্য তৈরি হয়।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া প্রতিহত করতে সিআরবি আন্দোলনের মত সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। পতেঙ্গা বিচের একাংশে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগের প্রতিবাদে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, উন্নয়ন ভাবনায় মৌলিক পরিবর্তন দরকার। সিআরবির মত জায়গায় কীভাবে হাসপাতাল হতে পারে? ডিসি বা বিভাগীয় কমিশনার কেন শহরের একটা পাহাড় চূড়ায় থাকবেন? লড়াইটা কঠিন। চট্টগ্রামের উন্মুক্ত স্থান ও পাহাড়গুলো রক্ষা করতে হবে। সিডিএ-সিটি করপোরেশন আমাদের সহযোগী হবার কথা ছিল। অথচ তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। বাসদ (মার্কসবাদী) চট্টগ্রাম জেলার সদস্য সচিব শফি উদ্দিন কবীর আবিদের সঞ্চালনায় সেমিনারে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বক্তব্য দেন।