১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার তরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তৎকালীন পুলিশের বাঙালি সদস্যরা। ২৫ শে মার্চের কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে তারা থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পাক হানাদারদের ভারী অস্ত্রের গোলায় ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল রাজারবাগের সবকটি ব্যারাক। অসংখ্য পুলিশ সদস্য অকাতরে জীবন দান করেন, মাথা নত করেনি তারা। এ রাজারবাগ থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পুলিশ সদস্যরা সাধারণ জনগণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি করেন। সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে তাঁরা ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তারা ছিনিয়ে আনেন আমাদের মহান স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
২৫ মার্চ, ১৯৭১ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স:
দুপুর ২টা– বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নানা রকম সংবাদ আসতে থাকে। পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে সারা শহরে পেট্রোল পার্টি পাঠানো হয়। পেট্রোল পার্টি বেতার মারফত সংবাদ পাঠাতে থাকে শহরের অবস্থা থমথমে ও আতঙ্কগ্রস্থ।
বিকাল ৪টা– মিরপুর, তেজগাঁও শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে সংবাদ আসতে থাকে অবাঙালি শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে আক্রমণাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সন্ধ্যা ৭টা– বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসে যে, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ হতে পারে, এ সংবাদে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন।
রাত ১০টা– তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে টহলরত একটি পুলিশ পেট্রোল পার্টি তেজগাঁও থানার বেতার (চার্লি-৭) মারফত জানায় যে, সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে এগুচ্ছে।
রাত ১০.৩০টা– বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পুলিশ পেট্রোল পার্টি জানায় যে, রমনা পার্ক (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৭০/৮০ টি সাঁজোয়া যান পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
রাত ১১টা– হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থানরত পেট্রোল পার্টির পুলিশ সদস্যগণ সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানের বহর দেখে রাজারবাগে এসে সংবাদ দেয় এবং পুলিশ সদস্যরা যে যার মত প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
রাত ১১.২০টা– সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানসমূহ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে অবস্থান নিতে থাকে। পাকবাহিনীর এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনসমুহে পুলিশ বেতার মারফত “Base for all station of east Pakistan police, keep listening, watch, we are already attacked by the pak army. Try to save yourself, over ” বার্তা প্রেরণ করা হয়।
রাত ১১.৩৫টা– রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করতে তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষী কনস্টবল আব্দুল আলী অস্ত্রাগারের পাগলা ঘন্টা পিটিয়ে সবাইকে একত্রিত করেন। অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত সেন্ট্রির রাইফেল থেকে গুলি করে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে নিজেদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরণ করে। পুলিশ সদস্যরা পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে, ব্যারাক ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়।
রাত ১১.৪০টা– পাক সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের মেইন গেটে এসে পৌঁছে এবং বাঙালি পুলিশ সদস্যেরা কৌশলগত স্থানে অবস্থান নেয়।
রাত ১১.৪৫ টা– রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের দক্ষিণ–পূর্ব দিক (পুলিশ হাসপাতাল কোয়ার্টার সংলগ্ন) এবং শান্তিনগর ডন স্কুলের ছাদ থেকে প্রথম গুলি বর্ষণ করা হয়। প্রায় সাথে সাথেই প্যারেড গ্রাউণ্ডের উত্তর –পূর্ব দিক (শাহজাহানপুর ক্রসিং) থেকে গুলির শব্দ শোনা যায় । ব্যারাকের ছাদে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাক সেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষন শুরু করে। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ । ইতিহাসে সূচনা হয় একটি নতুন অধ্যায়ের।
রাত ১২.০০টা– বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মরণপণ প্রতিরোধে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকবাহিনী। একটু পরই মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পিআরএফ এর ৪টি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। পাক বাহিনী ট্যাংক বহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। এ আক্রমণে পাক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় আটশত।
রাত ১২.৩০টা– পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। গেরিলা পদ্ধতিতে পাক বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং অনেককে হতাহত করে।
রাত ০২.৪৫- রাত ১১.৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেমে থেমে চলতে থাকে রাত ০৩.০০- ০৩.৩০ টা পর্যন্ত । বাঙালি পুলিশের কিছু সদস্য বুকে অসীম সাহস নিয়ে সমান তালে লড়ে চলে ট্যাংক, কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে। অপর একটি গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মালিবাগ-চামেলীবাগ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা শহরে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সেদিনকার সেই অস্ত্র আর গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে সারাদেশে, সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে এবং সন্মুখ সমরে।
রাত ০৪.১৫টা– কামান আর মর্টারের আক্রমণ এক সময় থামে, থেমে যায় রাজারবাগ মসজিদের মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে আযানের প্রথম ধ্বনি আল্লাহু-আকবর বলার পরই। বন্দি হয় প্রায় দেড়শত বাঙালি পুলিশ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স দখল করে নেয় দখলদার বাহিনী, তার আগেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের বীর বাঙালি পুলিশ অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ রাজারবাগ ত্যাগ করেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের যুদ্ধ তারাই ছড়িয়ে দেয় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে।
সেসব বীর পুলিশ সদস্যরা যারা ২৫ শে মার্চের কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নিজেদের জীবন বাজি রেখে, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল তৎকালীন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা। বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রাপ্ত তথ্য মতে মহান মুক্তিযুদ্ধের এই ৯ মাসে ৭৫১ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হওয়ার দলিল পাওয়া গেলেও। কিন্তু ধারণামতে প্রায় ১২০০ জন পুলিশ সদস্য শাহাদৎ বরণ করেন। সে বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। জাতি তাদেরকে আজীবন মনে রাখবে। বাংলাদেশ পুলিশ তাদের এ মহান দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।