প্রফেসর জোহরা আনিস ছিলেন রত্নগর্ভা মা। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা জোবেদা কনক খান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক। একমাত্র পুত্রসন্তান আরিফ মোর্শেদ খান নাক-কান-গলার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অধ্যাপনা করছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে। সুনামের সঙ্গে ডাঃ আরিফ মোর্শেদ কুমিল্লায় হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। কনিষ্ঠা কন্যা রাশেদা রওনক খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
এছাড়া রওনক জাতীয়ভাবে পরিচিতা একজন উপস্থাপক। আমার মনে আছে যেবার আরিফ মোর্শেদ খান এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিল জোহরা আনিস পুত্রের ছবি নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তখন রূপসী বাংলার স্টাফ রিপোর্টার হলেও বার্তাকক্ষের প্রধান ছিলাম। তখনকার কুমিল্লার একমাত্র দৈনিক রূপসী বাংলায় ছবি সহকারে তার সাক্ষাৎকার মুদ্রিত হয়েছিল।
সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে মানবসেবা করবে বলে লক্ষ্য স্থির করার কথা জানিয়েছিল। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। তাঁর মাতা জোহরা আনিসের নির্দেশও ছিল ঠিক এইরকম। মনে রাখতে হবে সেসময় কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের সীমানা ছিল টেকনাফ থেকে সিলেট। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, সিলেট শিক্ষা বোর্ড অনেক পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সাফিয়া খাতুনের হাত থেকে জোহরা আনিস রত্নগর্ভা মায়ের পদক গ্রহণ করেছিলেন। জোহরা আনিস শিক্ষায় ও সমাজসেবায় অবদান রেখেছিলেন বলে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছিলেন। তিনি সারাজীবন কুমিল্লা মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। মহিলা কলেজ যখন সরকারি মহিলা কলেজে রূপান্তরিত হয় তখন তিনি প্রফেসর পদে পদোন্নতি পান। কর্মজীবনে শেষ দিকে তিনি কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হন। এই পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতা করাকালীন তিনি সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ক্রীড়া-সংস্কৃতি-সমাজসেবার সবদিকেই তিনি সক্রিয় ছিলেন। বহু সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে রোকেয়া পদক ও অর্থমূল্য তুলে দেন।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন নবীনগরে। সারাজীবন কাটিয়েছেন শহর কুমিল্লায়। স্বামী আলহাজ্ব আনিসুল হক খান সরকারি খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি আইনের ডিগ্রী নিলেও কখনো আইন পেশায় যোগ দেননি। শৃঙ্খলার সঙ্গে সরকারি চাকুরী করেছেন। মনে-প্রাণে ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাকে কসবার সৈয়দাবাদে পৈতৃক বাড়ীতে সমাহিত করা হয়। ২১ অক্টোবর জোহরা আনিস মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫। টাউন হল মাঠে প্রথম জানাযা শেষে কসবার সৈয়দাবাদেই স্বামীর কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
জোহরা আনিসরা ছিলেন পাঁঁচবোন। তিনি ছিলেন সবার বড় । তাঁর ছোটবোনরা তাকে মাতৃতুল্যজ্ঞানে সমীহ করতো। বোনদের সব সন্তানদের তিনি নিজ সন্তানসম আদর করতেন। বোনদের সব সন্তানরাও মেধাবী। তাদের কেউ চিকিৎসক,ইঞ্জিনিয়ার,শিক্ষক হয়েছেন। জোহরা আনিসের লাশ যখন তাঁর ঝাউতলার বাসগৃহে আনা হয়েছিলো দেখেছি তাঁর বোনের সব সন্তানদের। তারা তখন শোকাহত ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড.জয়নাল আবেদীন ছিলেন জোহরা আনিসের দ্বিতীয় বোনের স্বামী। তাঁরা উভয়ে আগেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমি দেখেছি জোহরা আনিস কুমিল্লায় পিতৃতুল্য অভিভাবক মানতেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সহচর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান, গণপরিষদ সদস্য,ভাষা সৈনিক,মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,স্বাধীনতাউত্তর কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক,আওয়ামী লীগের কুমিল্লা জেলার সাবেক সভাপতি এডভোকেট আহমেদ আলীকে।
কুমিল্লায় কর্মরত দীর্ঘদিনের সংবাদকর্মী হিসেবে জোহরা আনিসের কর্মময় জীবনের সবকিছু আমার দেখা। সেজন্য যা লিখলাম দায়িত্ব নিয়েই লিখেছি। আমাকে তিনি অনুজসম স্নেহ করতেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন তিননদী পরিষদের পার্কের জামতলায় একুশের অনুষ্ঠান করছি ৩৮ বছর। এর মধ্যে জোহরা আনিস দুই দশকেরও অধিককাল তিননদীর একুশের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। এবার ফেব্রুয়ারি মাসেও সংস্কৃতিকর্মী রেজবাউল হক রানাকে নিয়ে জামতলায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়নকালীন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ১৯৬৭ সালের কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে তিনি ম্যাগাজিন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে অসুস্থ হয়ে ডায়াবেটিক হাসপাতালে ভর্তি হলে তিনি আমার সহধর্মিণী পারভীনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ সালে আমি যখন চেন্নাইয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম তখন তিনি বাগিচাগাঁও আমার বাসায় এসে আমার সন্তানদের সাহস জুগিয়ে গেছেন। কুমিল্লায় ফিরে আমার সন্তানদের কাছে সেই তথ্য পেয়েছিলাম।
জোহরা আনিস ধৈর্যের প্রতীক। কর্মজীবনে কেউ কেউ তাঁর সমালোচনা করতেন। আমি তাঁকে সেইসব দিক জানালে তিনি হাসিমুখে বলতেন যার যার সমালোচনা তার তার তাতে আমার কি? আমার আত্নবিশ্বাস আছে। কুমিল্লায় তাঁর কর্মময় জীবন অবশ্যই স্মৃতি হয়ে থাকবে। তাঁর কর্মময় জীবন থেকে অনেকেই উৎসাহিত হবেন। তিনি সবসময় তাঁর মা’কে স্মরণ করতেন। তিনি বলতেন তাঁর মা ছিলেন শিক্ষক। সারাজীবনের তাঁর আদর্শই ছিল তাঁর মা। তার মানে শিক্ষাই ছিল তাঁর ব্রত। আমি তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক: আবুল হাসনাত বাবুল সাংবাদিক,কলামিস্ট,গবেষক