চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকাণ্ডে দুটি মামলা হয়। প্রথম মামলার বাদী তার স্বামী ও সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। এ মামলার তদন্ত শেষে গত ১২ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একই দিন কয়েকজন সাক্ষীর তথ্যের ভিত্তিতে নগরের পাঁচলাইশ থানায় নতুন মামলা করেন মিতুর বাবা। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাবুল আক্তারকে।
এদিকে পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর গত ১৪ অক্টোবর বাদী হিসেবে নারাজির আবেদন করেন বাবুল আক্তার। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২৭ অক্টোবর শুনানির তারিখ ধার্য করেন। নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ আজ (বুধবার) আদালতে বাবুল আক্তারের উপস্থিতিতে শুনানি হয়। নারাজির আবেদনের যৌক্তিকতা নিয়ে এ সময় মামলার বাদী হিসেবে আদালতে বক্তব্য রাখেন বাবুল আক্তার।
আইনজীবী ও একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে আদালতে দেওয়া বাবুল আক্তারের বক্তব্যের বিষয়ে জানা গেছে, এ মামলার বাদী তিনি। মামলাটি প্রথমে নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। পরে পিবিআই একজন পরিদর্শক মর্যাদার কর্মকর্তা দিয়ে মামলাটি তদন্ত করায়। তদন্তে ৫৩ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেন। এদের মধ্যে ৫১ জন সাক্ষী হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি। মাত্র দুজনকে দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় সাক্ষী নেওয়ার মাধ্যমে বাবুল আক্তারকে দ্বিতীয় মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বাবুল আক্তার আরও বলেন, আইনানুযায়ী প্রথম মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিলের আগে মামলার বাদীকে জানাতে হয়। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিষয়টি বাদীকে অবহিত করেননি। উল্টো রিপোর্টে স্বাক্ষর করার জন্য আসতে বলে তাকে আটক করে রাখেন। দুদিন তাকে পিবিআই কার্যালয়ে আটকে রেখে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এরপর পিবিআইয়ের গাড়িতে করে মিতুর বাবাকে চট্টগ্রামে এনে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
তিনি দাবি করেন, আগের মামলায় তার বাবা-মা, মিতুর বাবা-মা ও খালাতো ভাইসহ নিকটাত্মীয় অনেকের সাক্ষী নেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত সাতজনের সাক্ষ্যগ্রহণের তথ্য কেস ডকেট থেকে গায়েব করা হয়েছে। অথচ তাদের সাক্ষ্যগ্রহণের পর পুলিশ নিজেই গণমাধ্যমে বক্তব্য রেখেছে এবং দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় বিষয়টি প্রচারিত হয়। এগুলোর কোনো তথ্যই এখন কেস ডকেটে নেই। এজন্য মামলার নথি পুলিশ থেকে জুডিশিয়াল হেফাজতে নিতে আদালতের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু এর আগেই নথি সরানো হয়।
আদালতে বাবুল আক্তার মিতু হত্যার প্রথম মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি গ্রহণ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য দাবি জানান।
এর আগে আজ (বুধবার) নারাজির আবেদনের শুনানির শুরুতে আদালতে কথা বলেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, মামলার কেস ডকেটে বেশ কয়েকজন সাক্ষীর কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়টি আমরা গণমাধ্যমের বরাতে জানতে পেরেছি। কিন্তু আদৌ তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে কিনা এবং তারা কি বলেছেন, তার কিছুই কেস ডকেটে নেই। আমরা ওই নথি তলবের জন্য আদালতে আবেদন করেছি। আদালত সেটি খারিজ করে দিয়েছেন। তবে সার্বিক বিবেচনায় নারাজি আবেদন গ্রহণ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আমরা আদালতের কাছে আবেদন করেছি। আদালত আগামী ৩ নভেম্বর আদেশ প্রদানের তারিখ ধার্য করেছেন।
তবে মামলার কেস ডকেট থেকে নথি গায়েবের বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) শাহীন ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, এটি আমার জানা নেই।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, মিতু হত্যায় দায়ের হওয়া প্রথম মামলার তদন্তে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পান তারা। এজন্য আগের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে নতুন করে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। দ্বিতীয় মামলায় আসামি ভোলা ও কয়েকজন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেছেন। প্রথম মামলায়ও কয়েকজন আসামি আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেছেন।
এতে উঠে আসে, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় খুন হন তার স্ত্রী। বাবুলের এ কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন তার সোর্স হিসেবে পরিচিত কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা। অস্ত্র সরবরাহ করেন এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা। হত্যাকাণ্ড শেষে বাস্তবায়নকারীদের বাবুল আক্তার তিন লাখ টাকা প্রদান করেন। মিতুকে হত্যা করতে মুসাসহ অন্যান্যদের অনেকটা বাধ্য করেন বাবুল।
তবে এসব বিষয় জানা গেলেও সবকিছুর সমীকরণ মেলাতে ‘জটিলতায়’ পড়েছে পিবিআই। কারণ সাড়ে ৫ বছরেও মিতু হত্যাকাণ্ডের প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সন্তান আখতার মাহমুদ মাহিরের জবানবন্দি কিংবা সাক্ষ্য নিতে পারেনি তারা। তার অবস্থানও এখনো শনাক্ত করা যায়নি। আবার যে সুইডিশ নারী গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে বাবুল আক্তার স্ত্রী মিতুকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে পিবিআই দাবি করে আসছে, সে গায়ত্রীর খোঁজ মেলেনি আজও। পাশাপাশি কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেওয়া কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পিবিআই। তিনি জীবিত আছেন নাকি মারা গেছেন সেই তথ্যও তাদের কাছে নেই। এছাড়া এই মামলার একাধিক আসামি এখনো পলাতক।
শুধু তাই নয়, দুটি বইয়ের একাধিক পৃষ্ঠায় গায়ত্রী ও বাবুল আক্তারের ‘প্রেমালাপ’ লিখা হয়েছিল বলে মিতুর বাবার দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। এই হাতেরলেখা গায়ত্রী কিংবা বাবুল আক্তারের কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি পিবিআই।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, গায়ত্রী অমর সিং যেহেতু জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কক্সবাজার কার্যালয়ে চাকরি করতেন, সেহেতু এ সংস্থায় তার লেখা সম্বলিত নথি চেয়ে চিঠি দেন তারা। কিন্তু পিবিআইয়ের দেওয়া সেই চিঠির এখনো সদুত্তর দেয়নি ইউএনএইচসিআর। গায়ত্রী-বাবুলের আগের লেখা পাওয়ার পর সেগুলো মেলানোর জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হবে। এছাড়াও প্রথম মামলা আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়াটাও ভাবাচ্ছে পিবিআইকে।
সবমিলিয়ে মিতু হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে পিবিআইয়ের ‘ছুটোছুটি’ শেষমেশ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। ক্লুলেস ও চ্যালেঞ্জিং বিভিন্ন মামলার জট খুলে প্রশংসিত হওয়া পিবিআইয়ের এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মিতু হত্যা মামলা। কারণ স্বয়ং একজন পুলিশের এসপি পিবিআইয়ের চোখে এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত। মামলার বাদী হয়ে যিনি নিজেই তার স্ত্রী হত্যার বিচার চান।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন এসপি ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলার প্রায় পাঁচ বছর শেষে গত ১২ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা এ প্রতিবেদন দাখিল করেন। একই দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন।
বাবুল আক্তার ছাড়াও ওই মামলার বাকি সাত আসামি হলেন- কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা (৪০), এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা (৪১), মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম (২৭), আনোয়ার হোসেন (২৮), খায়রুল ইসলম ওরফে কালু (২৮), সাইদুল ইসলাম সিকদার (৪৫) ও শাহজাহান মিয়া (২৮)।