করোনা মহমারির মধ্যেই ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো। আগের মতো আবারও তাদের টার্গেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত শুক্রবার রাজধানীর পল্টনের পুলিশ বক্সের কাছে একটি হাতে তৈরি বোমা বিস্ফোরিত হয়। একদিন পর শনিবার এক পুলিশ সদস্যের মোটরসাইকেল থেকে একটি বোমা সদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আরবি জিলহজ মাসকে জঙ্গিরা অধিকতর পবিত্র মাস হিসেবে বিবেচনা করে হামলার পরিকল্পনা করেছে। জঙ্গিরা তাদের নিজস্ব যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হামলার জন্য মরিয়া ভাব দেখাচ্ছে।
এ অবস্থায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা জানিয়ে ও প্রস্তুত থাকার জন্য গত ১৯ জুলাই পুলিশ সদর দফতর থেকে দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার, বিভিন্ন ইউনিট প্রধানদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বিমানবন্দর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও মিয়ানমারের দূতাবাসে ও সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের ওপর হামলার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জঙ্গিরা একেবারেই নির্মূল হয়ে যায়নি। তারা মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে থাকে। তবে বড় ধরনের কোনও হামলার সক্ষমতা বর্তমানে জঙ্গিদের নেই। তারপরও অধিকতর সতর্কতা ও নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে আমরা সবাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে করোনার মধ্যেও জঙ্গিরা অনলাইনে ব্যপক কার্যক্রম চালিয়েছে। বিশেষ করে সদস্য সংগ্রহ ও সংগঠিত করার কাজটি করেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের অনুসারী হিসেবে বাংলাদেশে নব্য জেএমবির সদস্যরা ‘উলাইয়াহ অব বেঙ্গল’ বা সরাসরি বাংলাদেশের শাখা ঘোষণা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নব্য জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবু মোহাম্মদ আল বাঙালি নামে এক ব্যক্তি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখনও তাকে শনাক্ত করতে পারেনি। তার সঙ্গে সিরিয়া ও খোরাসানের আইএসের শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এদিকে জঙ্গি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, করোনার সময়ে বিভিন্ন দেশে থেকে অনেক লোক দেশে ফিরেছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়া কোনও জঙ্গি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনও শীর্ষ জঙ্গি দেশে ঢুকে থাকতে পারে। যিনি নতুন করে আবার নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করে তোলার কাজ করছে। এছাড়া নব্য জেএমবি তাদের কৌশল পাল্টে উলফ প্যাক ও স্লিপার সেল পদ্ধতিতে কাজ করছে।
ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও উত্তরবঙ্গ কেন্দ্রিক পৃথক পৃথক সেল সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রিক স্লিপার সেলটি গত বছরের বিভিন্ন সময় ঢাকার পাঁচটি স্থানে পুলিশ ও পুলিশের গাড়ির ওপর হামলা করার পর নারায়ণগঞ্জের একটি আস্তানা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ওই আস্তানা থেকে ‘ফ্রিজ বোমা’ উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করা হয়েছিলো। গ্রেফতার করা হয় ওই সেলের প্রধানসহ বেশ কয়েকজনকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি একাধিক অভিযানে নব্য জেএমবির বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারাও জিজ্ঞাসাবাদে নতুন করে সংগঠিত হয়ে পুলিশকে টার্গেট করার কথা জানিয়েছে। এছাড়া গত শুক্রবার পল্টনে বিস্ফোরিত বোমার উপকরণের সঙ্গে গত বছরের ঢাকায় বিস্ফোরিত বোমার মিলও রয়েছে। এ কারণে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, একই ম্যানুয়াল থেকে ভিন্ন ভিন্ন সেল বোমা তৈরি করে পুলিশকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে।
ঢাকার কাউন্টার টেরোজিম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, কথিত হিজরতের নামে বিভিন্ন সময়ে বাসা থেকে অনেক তরুণ ঘর ছেড়েছিলো, তাদের অনেকের এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারাই নব্য জেএমবির বিভিন্ন সেলে এখন সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোও করোনা মহামারির মধ্যেই আবারও সবাইকে নিজ নিজ দেশে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এ কারণে জঙ্গিরা নতুন করে হামলার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া এবং সদস্যদের উজ্জীবিত রাখার জন্য মাঝে মধ্যেই কিছু একটা করার চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাদের কাছে তেমনটাই মনে হচ্ছে। কারণ তাদের সক্ষমতা অনেকাংশেই কমে গেছে। এমনকি গত বছর যেসব আইইডি তারা ব্যবহার করেছিলো ও সম্প্রতি বিস্ফোরিত বোমার উপাদান দেখে মনে হয়েছে শক্তিশালী কিছু তৈরির সক্ষমতা তাদের নেই। বিষয়গুলো নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবু আমরা সতর্কতা অবলম্বন করে নিয়মিত নজরদারি করে আসছি।’
এদিকে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যেহেতু জঙ্গিরা পুলিশকে টার্গেট করে আসছে এ জন্য পুলিশ সদস্যদের সচেতনতা ও সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ পরিত্যক্ত অবস্থায় গাড়ি বা যানবাহন ফেলে না রাখা, কিংবা গাড়ির আশপাশের লোকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় পুলিশের পোশাক পড়ে জঙ্গিরা যাতে ভেতরে প্রবেশ করার কৌশল নিতে না পারে, এ জন্য পোশাক পরিহিত পুলিশ সদস্যদের পরিচয় নিশ্চিত করার কথাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি অনেক চেষ্টা করলেও পুলিশ সদস্যদের বড় কোনও ক্ষতি করতে পারেনি জঙ্গিরা। জঙ্গিরা পুলিশকে টার্গেট করে বাহিনীর সদস্যদের মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।