সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে অনলাইনে কেনাবেচার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। সীমান্ত জেলার বিক্রেতাদের মাধ্যমে ঢাকায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ২০টি গরুর হাট বসানো হবে-দুই সিটি কর্পোরেশন।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এটা প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে। তারপরও প্রতিবছর দেশে বিড়ি-সিগারেটে আসক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের পাদুর্ভাবের পর ‘স্বাস্থ্যাবিধি মানা বাধ্যতামূলক’ শর্ত দিয়ে গণপরিবহন, লঞ্চ, ট্রেন, মার্কেট, শপিংমল খুলে দেয়া হয়। শর্ত মেনেই সবকিছু খোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে সিগারেটখেকোদের মতোই কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। গত ১৫ মাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ‘লকডাউন ‘কড়া বিধিনিষেধ’ বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনার অবজ্ঞায় প্রমাণ হয়েছে কেউ সেগুলো মানেনি এবং নাগরিকদের মানতে বাধ্য করার চেষ্টাও হয়নি। মাস্ক ব্যবহার, জীবাণুনাশক টানেল, স্যানিটাইজারসহ সব ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশ দেয়া হলেও কার্যকর তেমন হয়নি। সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পরও এর মধ্যেই করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা সীমান্ত জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। গতকালও আইসিডিডিআরবি গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ‘ঢাকায় করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬৮ ভাগ মানুষের নমুনায় করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
এ অবস্থায় বছর ঘুরে আসছে মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আগামী মাসের ২০ অথবা ২১ তারিখে ঈদ উদযাপিত হলে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট বসতে শুরু করবে। ওই সব পশুর হাট কার্যত হয়ে যাবে, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ছড়িয়ে পড়ার চারণভ‚মিক। রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট বসানোর অর্থই হবে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ভয়াবহ প্লাটফর্ম। তবে বিশেজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, অনলাইনে কোনরানির পশু কেনাবেচাকে প্রাধান্য দিলে রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে ভিড় কমে যাবে। এতে করোনা সংক্রমণ কিছুটা হলেও কম হবে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ বলেন, সীমান্তবর্তী জেলা এবং তার পাশের জেলাগুলোতে এখন করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বেশি। ফলে এসব এলাকার গরু ব্যাপারীরা যখন রাজধানীর বিভিন্ন হাটে গরু নিয়ে আসবেন, তখন তারা সত্যিকার ঝুঁকি নিয়ে আসবেন। এ বছর ঝুঁকির ধরনটা বেশি। এবারে তারা এমন একটা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আসবেন, যেটার নাম ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং এটা আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট বসানো হলে, সেখান থেকেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানবে না; আর পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। সীমান্ত জেলা কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ যেসব জেলায় করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বেশি, সেসব জেলা থেকেই গরু রাজধানী ঢাকার পশুর হাটগুলোতে আনা হবে। পশুর সঙ্গে আসবে হাজার হাজার ব্যাপারী (মানুষ)। রাজধানীতে পশুর হাটেই হবে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়ানোর মেলা। বিশেষজ্ঞরা ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে পশুর হাট না বসিয়ে বিকল্পভাবে পশু কেনাবেচার পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা করা যায় কি-না সে ব্যাপারে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের চিন্তাভাবনার পরামর্শ দেন।
চলতি বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণের হার কমে গেলেও এখন হুহু করে বাড়ছে ডেল্টা সংক্রমণ। বিশেষ করে সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার সামাজিক সংক্রমণ বেড়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬৩ জন মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের। ওই দুই বিভাগের সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার ডেল্টা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আইসিডিডিআরবি গতকাল আরো ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। তাদের গবেষণায় বলা হয় সীমান্ত জেলাগুলো থেকে মানুষ অবাধে রাজধানী ঢাকায় আসা যাওয়া করায় ঢাকায় করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বেড়ে গেছে। রাজধানীতে নমুন পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে নতুন যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন- তাদের মধ্যে শতকরা ৬৮ ভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত।
বিশ্বের যেসব দেশে করোনা নমুনা পরীক্ষা কম হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কম নমুনা পরীক্ষার মধ্যে গতকাল শনাক্তের হার ছিল ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সীমান্ত জেলাগুলোর কোনোটিতে শনাক্তের হাড় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ কয়েক মাস আগে শনাক্তের হাত ৮ শতাংশে নেমে এসেছিল।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য থেকে জানা যায়, এখন দেশের ৩৩ জেলায় করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। দেশে মোট আক্রান্ত রোগীর ৯৫ শতাংশ এই জেলাগুলোতে। সংক্রমণ বেশি জেলাগুলো হলো: ঢাকা বিভাগের ঢাকা, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ; চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চাঁদপুর; সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেট; ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নেত্রকোনা; রংপুর বিভাগের রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর; রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট, বগুড়া ও নওগাঁ এবং খুলনা বিভাগের যশোর জেলা। এই জেলাগুলোর মধ্যে রংপুর বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু’একটি জেলা ছাড়া অন্যান্য সব জেলা থেকে রাজধানীর ঈদের পশুর হাটে গরু আসে।
রাজধানীতে ডেল্টা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার মধ্যেই আসছে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। একদিকে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ; অন্যদিকে ঈদের প্রস্তুতি। এর মধ্যেই রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট বসানোর প্রস্তুতি চলছে। রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ২০টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১৩টি এবং ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ৭টি হাট। এর বাইরে ঢাকা উত্তরে গাবতলী এবং ঢাকা দক্ষিণের সারুলিয়ায় দুটি স্থায়ী পশুর হাট রয়েছে। কোরবানির পশু বিক্রির জন্য অস্থায়ী হাটগুলোর স্থান নির্ধারণ করে সেগুলোর ইজারার জন্য প্রথম দফার দরপত্র আহবান করা হয়েছে। ঢাকা শহরের এই হাটগুলোতে বেশিরভাগ পশু আসে সীমান্ত অঞ্চল থেকে। এরই মধ্যে ওই সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।
২০২০ সালে করোনার মধ্যেই রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট বসেছিল। গত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীর হাটগুলোর বেশিরভাগ পশুই আসে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে। ওই জেলাগুলোতে গড়ে উটেছে দেশের বেশিরভাগ পশুর খামার। এ ছাড়া ওই জেলাগুলোর সঙ্গে রয়েছে দেশের সীমান্ত সম্পর্ক। করোনার কারণে এসব সীমান্ত সরকারি ঘোষণায় বন্ধ থাকলেও এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। গত কয়েক দিনের সংক্রমণের হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের কোনো কোনো জেলায় দৈনিক নমুনা পরীক্ষায় ৬০ শতাংশেরও বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সীমান্ত জেলাগুলো থেকে ঢাকার দিকে আসছে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ। এ অবস্থায় এখনই রাজধানীর পশুর হাট বসানো হলে কার্যত সেটা হয়ে যাবে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার হাটবাজার। বিক্রেতারা সীমান্ত জেলাগুলো থেকে করোনা বহন করে ঢাকা আসবেন। ক্রেতারা গরু ক্রয়ের সঙ্গে সে করোনারভাইরাসে সংক্রমিত হবেন। পশুর হাটে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসিতে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। তবে রাজধানীতে পশুর হাট বসানো হলে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
গত বছর করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কোরবানির ঈদের আগে অনলাইন হাট থেকে বেচাকেনা হয়েছে গরু-ছাগল। অনলাইন থেকে ছবি দেখে পরে সরাসরি কৃষকের বাড়ি ও খামার থেকে গরু কিনেছেন ক্রেতারা। ‘ডিজিটাল হাট’ ও ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। সে সময় হাজার হাজার ক্রেতা অনলাইনের মাধ্যমে কোরবানির পশু ক্রয় করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ডেল্টা সংক্রমণ এড়াতে এবার সরকারি উদ্যোগে অনলাইন কোরবানির পশু ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে প্রান্তিক চাষিরা যেন সঠিক মূল্য পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এতে কিছুটা হলেও রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে ভিড় কম হবে।
কয়েকদিন আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ভারতের গরু সীমান্ত দিয়ে এবার রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটে যাতে না আসতে পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অনলাইন পশুর হাটের প্রতি জোর দিলে সেটা কার্যকর করা সহজ হবে।
রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেছেন, ইজারার জন্য আমরা ১০টি হাট চ‚ড়ান্ত করেছিলাম। স্বাস্থ্যবিধিকে গুরুত্ব দিয়ে ৩টি হাট তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। হাটগুলোতে মাস্ক, জীবাণুনাশক টানেল, স্যানিটাইজারসহ সব ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুর হাট বসানো হবে। সীমান্ত থেকে আসা গরু ব্যবসায়ীদের কারণে করোনার একটা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, সেটা মাথায় রেখেই আমরা পরিকল্পনা সাজাচ্ছি।