দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছেই। সঙ্গে মৃত্যুও। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্তবর্তী জেলা ও তার আশেপাশের জেলাগুলোতে। এক গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আরেক গ্রামে। প্রতিদিনই সীমান্তের গ্রামগুলোতে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। করোনার হট স্পট এখন সীমান্তবর্তী জেলাগুলো। এখানে ঘরে ঘরে রয়েছে করোনার উপসর্গ রোগী। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে কাবু জেলাগুলো।
এর পেছনের কারণ হিসেবে যোগ হয়েছে সীমান্তে অবাধে পারাপার। সীমান্তের চোরাই পথের সরু গলি দিয়ে কৌশলে চলছে এপার-ওপারে অবাধে যাতায়াত। জেলার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিলও। এসব জেলার হাসপাতালে খালি নেই শয্যা। গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে সংক্রমণের হার বেড়েছে ২৭ শতাংশেরও বেশি। সাতক্ষীরায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গে মারা গেছেন ১৩ জন। সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬৮ জন। করোনা শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে,
৫৩ দশমিক ৬৭ শতাংশে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী বাড়ার কারণে সাধারণ বেড ও আইসিইউ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী।
এদিকে জেলা সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩৫টি নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছেন ৭৪ জন। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ১৪৩ জন ভর্তি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার। খুমেক পিসিআর ল্যাবের পরীক্ষায় একদিনে ৫৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী খুলনা মেডিকেল কলেজ পিসিআর মেশিনে ১৮৮ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৫৬ জন খুলনা মহানগরী ও জেলার। এর মধ্যে ৫৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তদের মধ্যে খুলনা মহানগরী ও জেলায় ৪৯ জন, বাগেরহাটে তিন, যশোরে দুই, নড়াইলে এক ও মাগুরায় একজন রয়েছেন।
এদিকে গাংনী (মেহেরপুর) প্রতিনিধি জানান, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী তেঁতুলবাড়ীয়া গ্রামেই ১৩ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৩৭ জনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ২৩ জন। তবে উপজেলার সীমান্তবর্তী তেঁতুলবাড়ীয়া গ্রামেই ১৩ জন, মেহেরপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৯ জন ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৫ জন। মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডাক্তার নাসির উদ্দীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে মেহেরপুর জেলার গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। ভারতে বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণে এ রোগে সীমান্তবর্তী গ্রামে প্রভাব বিস্তার করছে। কারণ মেহেরপুরের সীমান্তের ওপারে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা। এ জেলার করিমপুর, তেহট্টি ফুলবাড়িয়া, বারুইপোতা, খানজিপুর, মোবারকপুর, লালবাজার, কৃষ্ণনগর, বেতায়, গোবিন্দপুর, হৃদয়পুর, সাহাপুর, নবীননগর গ্রাম। সীমান্ত সিলগালা থাকা সত্ত্বেও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে শত শত ভারতীয় কৃষক প্রবেশ করছেন নোমান্সল্যান্ডে। ফলে দু’দেশের কৃষকরা পাশাপাশি মাঠের ক্ষেতে কাজ করছেন।
ক্ষেতে কাজ করার সময় দু’দেশের কৃষকরা কখনো কখনো এক সঙ্গে মেলামেশা করছেন। গাংনীর সীমান্তবর্তী মৈত্রাপুর গ্রামের কৃষক মোকাদ্দেস আলী জানান, আমরা সীমান্তবর্তী গ্রামে বসবাস করি। মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরে ভারত। তফাৎ শুধু কাঁটাতার। একই জমির পাশাপাশি কাজ করতে হলে, দু’দেশের কৃষকদের মেলামেশা স্বাভাবিকভাবে হয়ে ওঠে।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর হাসপাতালে করোনা রোগীদের শয্যা খালি নেই: সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা খালি থাকছে না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত কিছু দিনে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে। গতকাল করোনার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়ে আরও বলেন, জানুয়ারি থেকে হিসাব করলে এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে। জুনে সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা খালি থাকছে না।
গত কিছু দিনে আমরা খেয়াল করেছি, সমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে। সেই জেলাগুলোকে তিনটি ক্লাস্টারে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ক্লাস্টারে রয়েছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর। সেখানে শতকরা হিসেবে শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের বেশি। দ্বিতীয় ক্লাস্টারে আছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁ। তৃতীয় ক্লাস্টারে রয়েছে সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা ও চুয়াডাঙ্গা। এই জেলাগুলোতে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছে। আমরা অনুরোধ করবো মৃদু উপসর্গ দেখা দিলেই যেন প্রত্যেকে হাসপাতালে যান। আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্ত বেশি। পূর্ববর্তী সপ্তাহের তুলনায় ২৬ জন বেশি মারা গেছেন।
স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে একটু মনোযোগী হলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক মৃত্যু আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। এই সাতদিনে সংক্রমণের চিত্রে একটি স্থিতি অবস্থা দেখতে পাচ্ছি যা ঊর্ধ্বমুখী। একটি কমার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। সীমান্ত ছাড়াও কিছু কিছু জেলায় পরীক্ষায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, যেমন ফরিদপুর। কম পরীক্ষা হচ্ছে বলেই শতকরা হার বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেসব ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার চাপ বেশি সেখান থেকে তুলনামূলক চাপ কম এমন ল্যাবে নমুনা পাঠানো হবে। অধিক সংক্রমিত সীমান্তবর্তী এলাকায় বিনামূল্যে পরীক্ষা হচ্ছে। যতক্ষণ ৮০ ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা না যাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই।