স্বাধীন সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলেই অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক সূচকেও দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আগের তুলনায় অবনতি হয়েছে।
সম্প্রতি একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এক আইনে মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় তীব্র সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে আইনি চাপ আর নানা বাধার কারণে সাংবাদিকতা করা বাংলাদেশে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে বলেই পেশাদার সাংবাদিকরা অভিযোগ করছেন।
স্বাধীন সাংবাদিকতা করার পরিবেশ খুবই খুবই সংকীর্ণ”
সাংবাদিকরা বলছেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদেরকে নানামুখী চাপ আর বাধার সম্মুখীন হতে হয় । বেশিরভাগ সাংবাদিকই এখন এটা অনুভব করেন না যে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করার জন্য একটা মুক্ত পরিবেশ আছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টার- এর সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম বলেন, নতুন পুরোনো আইন ও এর প্রয়োগের কারণে বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
“সরকার বলবে যে খুবই সাংবাদিক বান্ধব সরকার আবার আমরা সাংবাদিকরা বলবো যে আমরা অত্যন্ত চাপের মুখে আছি। আসলে বিচার্য বিষয় হচ্ছে আইন। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নাই। এটা সরকারও বলবে না যে এসব আইন নাই। আইন আছে এবং আইনের প্রয়োগ এই দুটো বিচার করলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে সাংবাদিকতার পরিবেশ এখন বাংলাদেশে এখন কী রকম একটা ভয়াবহ। এবং আমি মনে করি যে স্বাধীন সাংবাদিকতা করার পরিবেশ খুবই খুবই সংকীর্ণ হয়ে আসছে”।
মি. আনাম বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সম্প্রতি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা এবং মানহানি মামলা একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
“আসলে সাংবাদিকতার পরিবেশটা হচ্ছে এটা একটা মুক্ত পরিবেশ। এখন মুক্ত পরিবেশতো শুধু মুখে বললে হবে না। আমাকে তো অনুভব করতে হবে যে আমি সত্যিকার অর্থে একটা মুক্ত পরিবেশে কাজ করছি।”
বাংলাদেশে চলতি মাসে মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে প্রকাশিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে শেষের দিকে ১৫২ তম অবস্থানে।
সূচকে গত বছরের চেয়ে বাংলাদেশ একধাপ পিছিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার সর্বপরি দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের চেয়ে পেছনে। তবে আন্তর্জাতিক এ সূচকের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা।
ইয়াং জার্নালিস্টদের ক্ষেত্রে আতঙ্কের বিষয় সেলফ সেন্সরশিপ”
সাংবাদিকতার বিরূপ পরিবেশের কারণে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মাঠ পর্যায়ে অনেক সিনিয়র সাংবাদিককে বিকল্প পেশায় চলে যেতে দেখা গেছে।
কেউ কেউ বাধ্য হয়েছেন পেশা পাল্টাতে। টেলিভিশনে অনুসন্ধানি সাংবাদিকতা এবং এ নিয়ে অনুষ্ঠান নির্মানে যুক্ত বদরুদ্দোজা বাবু এরকমই একজন।
তার অনুসন্ধানী সংবাদের অনুষ্ঠান যখন জনপ্রিয় ঠিক তখনই আচমকা টেলিভিশন ছাড়তে হয় তাকে। নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে আবার সাংবাদিকতা শুরু করেননি। বদরুদ্দোজা বাবু বলেন, বেশকিছু অনুসন্ধান প্রকাশ করতে না পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে।
যা করে এসেছি অনুসন্ধানে অন্ততপক্ষে সেইটুকুও যদি কোথাও না করতে পারি বা ওইটুকুও যদি পরিবেশ না পাই তাহলে কোথাও চাকরি করে লাভটা কী?
বদরুদ্দোজা বাবু সাংবাদিকতা ছেড়ে অনুসন্ধানি সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ এবং বিকাশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন।
সাংবাদিকতার বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তরুণ সংবাদকর্মীদের মধ্যে একটা মানসিকতা তিনি লক্ষ্য করছেন যেটা তার ভাষায় আতঙ্কের।
“ইয়াং জার্নালিস্টদের ক্ষেত্রে যেটা আতঙ্কের বিষয় সেটা হচ্ছে সেলফ সেন্সরশিপ। তারা ধরেই নিয়েছে যে এই এই বিষয়গুলো নিয়ে রিপোর্ট করাই যাবে না। ওই বিষয়গুলো নিয়ে যদি আমি রিপোর্ট করি সেটা আমার সময় নষ্ট এবং আমার জীবনের জন্যও ঝুঁকি হতে পারে। সুতরাং তারা যখন চিন্তাভাবনা করে কোনো রিপোর্ট নিয়ে, তারা অনেকগুলো বিষয় বাদ দিয়েই চিন্তা করে।”
সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অসহযোগিতা
টেলিভিশন, অনলাইন বা সংবাদপত্র যে মাধ্যমেই হোক বর্তমানে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অসহযোগিতা বহুমূখী চাপ আর বাধার মুখে পড়ছেন বলেই অভিযোগ উঠছে।
সংবাদপত্রে প্রায় তিন দশক ধরে রিপোর্টিং করছেন শাহনাজ বেগম। বর্তমানে দ্যা ডেইলি অবজারভার পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি তিনি।
শাহনাজ বেগম বলেন, গত ৫-৭ বছরে রিপোর্টারদের জন্য নতুন সংকট সামনে এসেছে তথ্য সংগ্রহের পর সেটি যাচাই করে প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে।
“অনেক রিপোর্টকে মরে যেতে হয়। অনেক রিপোর্ট থাকলেও যেহেতু কেউ বক্তব্য দিতে চাচ্ছে না কোটেড হতে চাচ্ছে না, যদি সেই ক্ষেত্রে আমার কাছে ওই ডকুমেন্টটাও শো করার মতো জায়গা না থাকে, তাহলেতো আমার রিপোর্টটাকে আমি প্রেজেন্ট করতে পারছি না। আমি আমার কথা বলছি না আমি সব রিপোর্টারদের কথা বলছি।”
“সচিবের কাছে কিংবা মন্ত্রীর কাছে সবাইতো ফোন করলে ধরেন না মন্ত্রী। সুতরাং এই জায়গাগুলোতে আমি মনে করি রিপোর্টিংয়ের জায়গায় থেকে পেশাগত জায়গায় এটা একটা বড় সংকট তৈরি হয়েছে। এবং গত ৫-৭ বছরে এ সমস্যাটা প্রকট হয়েছে।”
সাংবাদিকদের তথ্য না দেয়া, অসহযোগিতা এবং সর্বপরি একটা গোপনীয়তার যে প্রবণতা বেড়েছে সেটিও উদ্বেগের বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম।
“সাংবাদিকদের যে অধিকার, সে অধিকারতো রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক সরকার সেটাকে সমর্থন করবে। আমলাতন্ত্র বা গোপনীয়তার অভ্যাসের বিরুদ্ধে গিয়ে। কিন্তু আমরা সে সহায়তা পাচ্ছি না।”
মান আর পেশাদারিত্ব কতটা বেড়েছে?
এদিকে বাংলাদেশে গত এক দশকে সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা অনেকে বেড়েছে এবং সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে গর্ব করা হয়। কিন্তু সংখ্যা বাড়লেও প্রশ্ন রয়ে গেছে মান আর পেশাদারিত্ব কতটা বেড়েছে সেই জায়গায়। শাহনাজ বেগম বলছিলেন মারাত্মক অভাব রয়েছে সাংবাদিকেদর প্রশিক্ষণের জায়গায়। তার ভাষায়,
“ইনহাউজ প্রশিক্ষণতো নাই বললেই চলে আর জাতীয়ভাবেও প্রশিক্ষণের যে উদ্যোগ আছে সেটা যথেষ্ট নয়।”
এই সংবাদটা যেন প্রকাশ না হয়”
একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার কাবেরী মৈত্রেয় দীর্ঘদিন বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক বীমা ও শেয়ারবাজারসহ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে সাংবাদিকতা করছেন।
সংবাদপত্র টেলিভিশন মিলিয়ে প্রায় এক দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তার। নিজের অভিজ্ঞতা আর পরিবেশ পরিস্থিতি বিচার করে কাবেরী বলছেন রিপোর্টারদের কাজ দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়ছে।
“কোনো একটি সংবাদ যেন প্রকাশ না হয় এই চাপটা মনে হয় যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি হয়ে গেছে। যেমন একটি সংবাদ সংগ্রহ করতে যাচ্ছি যার বিরুদ্ধে এটি যাবে সে হয়তো আমার অফিসের কোনো কর্তৃপক্ষ বা মালিক বা অন্যকাউকে তাকে হয়তো ফোন করছে। এবং তাকে বলছে যে উনি আমার কাছে এসেছিলেন এই সংবাদটা যেন প্রকাশ না হয়। এবং সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে এগুলোতো অন্যতম বড় হাতিয়ার হিসেবে আছেই।”
মালিকানা এবং ব্যাবসায়িক প্রভাবশালীদের চাপ
বাংলাদেশে মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আইনি বাধার পাশাপাশি মালিকানা এবং ব্যাবসায়িক প্রভাবশালীদের চাপের বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি ঢাকায় একটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর মালিকপক্ষের একজনের বিরুদ্ধে মামলার খবর প্রকাশ ও প্রচার নিয়ে বিতর্ক দেখা গেছে।
গণমাধ্যমের মালিকানার চাপের বিষয়টি স্বীকার করেই মাহফুজ আনাম বলছেন আইনি চাপের কাছে সেটি নগন্য।
“এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। আপনি বিদেশে বহু বহু বড় কাগজে দেখবেন যে একটা ঘটনা একটা কাগজে বড় করে দেয়া হয়েছে আরেক কাগজে সেটার অস্তিত্বই নাই। এটা বলতে পারেন যে পেশাগত একটা চ্যালেঞ্জ। মালিকদের একটা প্রভাব থাকেই। এ ধরনের একটা দুটো ত্রুটি ছাড়া মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার একটা ধারা তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে স্বাধীন সাংবাদিকতা করার একটা আকাঙ্ক্ষা জাগছে, তাদের একটা দাবি জাগছে। আমার চোখে আইনি কাঠামোগুলোই হচ্ছে সবচে সবচে বড় প্রতিবন্ধকতা।”
আন্তর্জাতিক সূচকের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন
স্বাধীন সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের ওপর চাপ সবসময় সবদেশেই ছিল এবং আছে তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি যেভাবে অবনতি হচ্ছে সে কারণেই সবাই উদ্বিগ্ন।
যদিও সরকারের নীতি নির্ধারকরা বরাবরই বলে থাকেন এ সরকার সাংবাদিক বান্ধব সরকার।
এছাড়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যে আন্তর্জাতিক সূচক সেটিও কতটা বস্তুনিষ্ঠ সে প্রশ্ন তোলা হয়। সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার সূচক নিয়ে “রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ নয়। ।”
এছাড়া সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপ কেন করবে এ প্রশ্ন তুলে মি. ইনু বলেন, “সাংবাদিক কী বিষয় প্রকাশ করতে বিরত থাকে আমি জানতে চাই। খুনের ঘটনা প্রকাশ করতে, এমপির দুর্নীতি প্রকাশ করতে, মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি প্রকাশ করতে? কোন বিষয় প্রকাশ করতে বিরত থাকতে হয়েছে আমিতো জানি না! বড় বড় দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, ক্যাসিনো কাণ্ড, বালিশ কাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে, গ্রেপ্তার হয়েছে। কর্নেল সাহেব এসপি সাহেবদের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গত ১২ বছরে গণমাধ্যম এই সরকারকে সাহায্য করেছে।”
হাসানুল হক ইনু উল্টো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন যে তথ্য অধিকার আইনে সাংবাদিকরা তথ্য পেতে পারেন কিন্তু সাংবাদিকরা এটি ব্যবহার করেন না।
কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেয়ে সাংবাদিকরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত তথ্য পাননি এমন নজিরও রয়েছে।
এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা মনে করেন দুর্নীতি বা অনিয়মের তথ্য সরকার কখনোই দিতে চাইবে না এক্ষেত্রে অনুসন্ধান করে সাংবাদিককেই কৌশলে তথ্য বের করতে হবে।
সাংবাদিকতার কারণে অনেককেই নানা ধরনের মামলা মকদ্দমার শিকার হতে হচ্ছে এ প্রসঙ্গ তোলা হলে জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, “মামলা মকদ্দমায় সবাই পড়ে না”।