কসোভোতে পাহাড় আছে, বন আছে, সমভূমি আছে, দুচারটে ছোটখাটো টাইপের নদী থাকলেও এখানে সেখানে জলাশায় খুব একটা নেই। প্রিজরেন অঞ্চলে নদী নালা একটু বেশীই ছিল, বেশ তাজা মাছও পাওয়া যেত। এছাড়া কসোভোতে মাছ বলতে আমরা মূলত ফ্রোজেন ফিশকেই বুঝতাম
সুপার শপ গুলোতে বিভিন্ন দেশের, সাইজের এবং স্বাদের নানা জাতীয় চটকদার প্যাকিং এর মাছ থাকলেও তাদের স্বাদ ছিল একই রকম, তা আর যাই হোক মাছেভাতে বাঙালীর মুখে রোচার কথা নয় সে তুলনায় ফ্রোজেন মুরগীতে তবুও মুরগীর গন্ধ, টেস্ট কিছুটা হলেও থাকতো। লাইভ ফিশ ছিল নিতান্তই দুর্লভ জিনিষ।
মিশনে আমাদের সাথে এক কলিগ ছিল নাম সার্জেন্ট গাজী আবুল হোসেন। আমাদের সাথের মিশনটি ছিল তার ৪র্থ মিশন এবং কসোভোতে দ্বিতীয় মিশন। কসোভোর অনেক কিছুই তার নখদর্পনে। আমাদের তাজা মাছের হা পিত্যেশ দেখে সে কিছুদিনের মধ্যেই কিভাবে যেন লাইভ ফিসের একটি ফার্ম খুজে বের করল।
প্রিস্টিনা শহর থেকে ৪০/৫০ কিঃ মিঃ দূরের এক গ্রামে ১৪/১৫ বিঘা সাইজের একটি ফিশ ফার্ম ছিল। মালিক ছিল ইউএন এর একজন দোভাষী। সে মূলতঃ মিলিটারি বেইজে কাজ করতো। সে জানতো যে, সৈনিকদের মাঝে মূলত বার বি কিউ করার জন্য মাছের খুব চাহিদা। তার গ্রামের বাড়ীটি পাহাড়ের ঢালে, ঝর্ণার পানি আর পাহাড়চুড়ায় বরফ গলা পানি জমিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে সে ৪/৫ ফুট গভীর এক জলাশায় করে তাতে ছোট ছোট খন্ড করে দ্রত বর্ধনশীল জাতের তেলাপিয়া, কই সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন করতো। সে মূলত ইউএন এর ইটালিয়ান আর্মি বেইজেই মাছ সাপ্লাই দিতো। বাইরে খুব একটা বিক্রি করতো না। তার মাছ ধরার নির্দিষ্ট সময়ে যেতে পারলে ঐ দামেই মাছ কেনা যেত।
গাজীর সাথে এক শনিবার দুপুরে মাছের ফার্মে গেলাম। ৫ ইউরো কেজি দরে তাজা তেলাপিয়া মাছ কিনলাম। ১০ কেজির বেশী দিতে চাচ্ছিলোনা। অনেক জোরাজুরি করে ২০ কেজি নিলাম,কারন আমরা সববমিলিয়ে ১৫/১৬ জন বাংলাদেশী অফিসার প্রিস্টিনাতে ছিলাম।
বাসায় ফিরে ঐ দিন রাতেই ফিশ পার্টি দিলাম। তেলাপিয়া ফ্রাই আর বড় কড়াইতে আলু ভাজা। এর সাথে কোক, পেপসি আর স্পেশাল চা মিলিয়ে জম্পেস ডিনার হল। এরপর প্রতি মাসেই আমরা পালা করে ওখানে গিয়ে তাজা মাছ কিননতাম। প্রথমে তেলাপিয়া দিয়ে শুরু হলেও পরে ক্যাট ফিস, কার্প-ফিস সবই বাসায় আসতে লাগল এবং মাছ নিয়ে চলতে লাগলো আমাদের হরেক রকম এক্সপেরিমেন্ট। কসোভোতে প্রচুর মিষ্টি কুমড়া পাওয়া যেত। কুমড়া খেয়ে বীচি খালি জায়গায় ফেলে দিলেই ইয়া মোটা ডগার কুমড়া গাছ হত, বিশাল বিশাল তার পাতা। কুমড়ো পাতা, কুমড়ো ডগা দিয়ে মাছের ঝোল ছিল কসোভোতে আমাদের অন্যতম সেরা খাবার। যাহোক ফিশ রেস্টুরেন্টে অভিযানের কথা বলতে গিয়ে লাইভ ফিশের ফিরিস্তি এসে গেল।
প্রায়ই শনিবারে আমরা টিমের সবাই মিলে বাইরে কোথাও পেট্রলিং এ যেতাম। আমরা একে বলতাম কমবাইন্ড পেট্রল।এ পেট্রলিং এ কমপক্ষে ১০/১৫ টি ইউএন গাড়ী থাকতো। সিকিউরিটি হ্যাজার্ড বেশী থাকলে মিলিটারী গাড়ী ও থাকতো দুয়েকটা। এর বাইরে কসোভো পুলিশের গাড়ী ও থাকতো আলাদা ভাবে। এ রকম পেট্রলে গেলে আমরা ঐ এলাকায় জনপ্রিয় কোন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতাম। কে পি এস (কসোভো পুলিশ সার্ভিস) বা ল্যাংগুয়েজ এসিসটেন্ট রা ঠিক করতো কবে কোন রেস্টুরেন্টে খাব।
বরফ পড়া কমে এসেছে এপ্রিল বা মে মাসের এমনি এক শনিবারে আমরা কসোভো থেকে পিয়ার (PEJA)দিকে যেতে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ৭০/৮০ কিলোমিটার গিয়ে তারপর বামের পাহাড়ের দিকে ঢুকলাম একটি ফিল্ড রেকি কাম কম্বাইন্ড পেট্রলিং এ। আরেকটু বিষয় ও ছিল। মিশন হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে ২০০০ সালে কসোভো যুদ্ধের পর এখানকার একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট “বার্বি ফিশ ওয়ান্ডে” সংঘটিত বন্দুক ধারীদের গুলিতে একসাথে ৪২ জন সার্বিয়ান সম্প্রদায়ের লোক নিহত হওয়ার সত্যাসত্য অনুসন্ধানের দায়ীত্ব দেয়া হয় আমাদের ইউনিটকে ।
কসোভোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতির পর সীমিত আকারে রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড রিইন্টিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হয়। এর আওতায় যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন ইউএন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার নিকট হতে সীমিত আকারে আর্থিক প্রনোদনা পাওয়া শুরু করে। এর ফলে যুদ্ধে নিহত বা ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবারের পক্ষ থেকে সে সকল ঘটনায় মামলা দায়ের এবং নানাবিধ আইনী ব্যবস্থা গ্রহন ও বাড়াতে থাকে। কারন মামলা বা প্রতিকার চেয়ে ঘটনা রাষ্ট্রের গোচরীভূত করা ছিল সাহায্য বা সহযোগিতা প্রাপ্তির অন্যতম পূর্ব শর্ত। এক্ষেত্রে বেইজ লাইনটা ছিল এমন যে, সংঘটিত অপরাধ ঘোষিত যুদ্ধ বিরতির সময়ের পরে হতে হবে।
বার্বি ফিশ ওয়াল্ডের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে UNMIK পুলিশ কসোভো পুলিশকে অনুরোধ করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের। দাখিলকৃত প্রতিবেদনে মৃতের সংখ্যা, ক্ষতির পরিমান, এমন কি ঘটনার সময় নিয়েও প্রশ্ন উঠায় UNMIK HQS, SCIS (serious crimes investigation section) কে অনুসন্ধান পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের অনুরোধ করে। তার প্রেক্ষিতে আমরা এক শনিবার ভোরে বার্বি ফিশের উদ্দেশ্যে রওনা করি। এ ধরনের প্যাট্রলিং এর জন্য নিদিষ্ট স্যালারির অতিরিক্ত কিছু আর্থিক সুবিধাও ছিল। একে তো পার্বত্য অঞ্চলে আউটিং তার উপর আবার এডিশনাল পে, কাজেই টিমের ২০ জনের মধ্যে ১৩/১৪ জনই গেল।
এ ঘটনায় মিলিটারি সাপোর্টের জন্য মিলিটারির সাথে লিয়াজো করা লাগতে পারে বিধায় মিলিটারি লিয়াজো অফিসার কে আমাদের সাথে যাওয়ার রিকুইজিশন দিই। যথারীতি তা অনুমোদিত হয়। এমএলও মেজর হান্নান ভাইএর আমাদের সাথে যাওয়ার কথা থাকলেও উনার অনুপস্হিতিতে তার এক বেলজিয়াম কলিগ আমাদের সাথে যান। আমরা দুজন এক গাড়ীতেই যাই।
আমাদের ধারনা ছিল গহীন পার্বত্য অঞ্চলে আউটিং এ যাচ্ছি দলে বলে, ফিরে এসে একটা রিপোর্ট সাবমিট করলেই হবে। বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব, ভালই হবে। পরে অবশ্য ঘটনা রীতিমত এডভেঞ্চারে রুপ নেয়।
হাইওয়ে ধরে ৬৪/৬৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর বামে টার্ন করল আমাদের বহর। সামনে যথারীতি KPS team, এর পরে UN Security,এরপর ইউএন পুলিশ ভেহিক্যালস এবং সবশেষে মিলিটারি ভেহিক্যাল এবং সবশেষে আবারো কেপিএস এর গাড়ী। অর্থাৎ হামলা টামলা যাই হোক প্রথম রেসপন্ডার হচ্ছে কোসোভো পুলিশ। সারা দুনিয়ার বিধানই তাই। হামলা হলে আগে দুর্বলেরই প্রান যাবে।
দুর্গম এলাকায় এ ধরনের প্যাট্রলিং এ এয়ার সাপোর্ট থাকতো।ইউক্রেনিয়ান এয়ার সাপোর্ট টিম আমাদেরকে এরিয়াল সাপোর্ট দিচ্ছিল। সামনে লোকাল পুলিশ, পিছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ইটালিয়ান আর্মির ৩/৪ টি গাড়ী, তার মাঝে একটি সাঁজোয়া যান। কাজেই বেশ ফুরফুরা মেজাজেই এগুচ্ছিলাম।
ইউএন পুলিশ হিসাবে আমাদের সকলের কাছে ৭.৬২ এম এম বা ৯ এমএম অটোমেটিক পিস্তল। কাজেই শর্ট রেঞ্জ বা ক্লোজ রেঞ্জ ছাড়া আমাদের ফাইট করার কোন সুযোগ নেই। অভিযানটির প্রত্যাশী সংস্থা আমার ইউনিট অর্থাৎ স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম। আমার টিম মলিডার বেকন কোন কারনে ঐদিন যায়নি। কাজেই ডেপুটি টিম লিডার এবং অভিযানটির প্রত্যাশী সংস্থার চীফ হিসাবে আমিই অপারেশন কমান্ডার। মিলিটারি লিয়াজো অফিসারের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গীয় ইটালিয়ান মিলিটারি কনভয়কে অনুরোধ করলাম ব্যবস্থা নিতে। ওরা খুবই পেশাদারীত্বের সাথে ডায়ামন্ড ফর্মেশনে নিয়ে আসলো আমাদেরকে। সামনে একটি সাঁজোয়া গাড়ী, পিছনে একটি ৩ টনী সাজোয়া ট্রাক, বাম পাশে মিলিটারী একটা জীপ, ডানপাশে মিলিটালী জীপ। ইটালিয়ান মিলিটারী কনভয় কমান্ডারের গাড়ীটি এসে থামল আমাদের গাড়ীর ঠিক ডান পাশে। জানালার গ্লাস নামিয়ে কথা বললাম। তার ধারনা শব্দটি সম্ভবতঃ একে ৪৭ এর। দুবারের শব্দ একই রকম। তার মানে হয় একই অস্ত্র দিয়ে ফায়ারিং করা হয়েছে অথবা একই ধরনের একাধিক অস্ত্র ওদের কাছে আছে। সে আরও জানাল যে, ফায়ারিং এর ক্ষেত্রে রিবেলদের পজিশন অনেক শ্রেয়তর কারন তারা আছে পাহাড়ের চূড়ায় বা ঢালে সেই তুলনায় আমরা ভ্যালিতে অথাৎ নীচে। কমান্ডারের এবং কেপিএস এর কমান্ডারের ও ধারনা যে, আমাদেরকে টার্গেট করে নয় ভয় দেখানোর জন্য গুলি করা হয়েছে।
আমারো তাই মনে হল। আমরা তাদের হাফ কিলোমিটারের ও কম দূরত্বে। যে ধারনের অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে তার ইফেকটিভ রেঞ্চ কম বেশী এক কিলোমিটার। কিন্তু তাদের কোন গুলি আমাদের বহরে এমনকি তার আশেপাশেও পড়েনি। ইতিমধ্যে কেপিএস এর কমান্ডার আমাদের গাড়ীর কাছে চলে এসেছে। তার সাথে লোকাল পুলিশের স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের স্টেশন কমান্ডার। ওদের দেশে স্টেশন কমান্ডাররা তখন সাধারনত পুলিশ মেজর পদ মর্যাদার হত। তিনি আরো ১৫/২০ কিলোমিটার আগে আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছেন।
ইউএন এর এসওপি অনুযায়ী আমরা যখনি কোথাও কোন অভিযানে এমনকি পেট্রলিং বা তদন্ত সংক্রান্ত কাজেও যেতাম তখনি স্থানীয় পুলিশের একটি টিম আমাদের সাথে জয়েন করতো। কিন্তু তাদেরকে কখনোই আগে থেকে গন্তব্য বা টার্গেট সম্পর্কে ব্রিফ করা হতনা।
এলাকাটি ছিল সার্বিয়ান অধ্যুষিত। স্থানীয় পুলিশ স্টেশন কমান্ডার ও সার্বিয়ান এথনিক গোষ্ঠীর। সাধারনত যে এলাকার যে ধরনের জনবসতি ছিল সে এলাকাতে সেই সম্প্রদায়ের পুলিশ কমান্ডারেরই পদায়ন হত। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। যাহোক স্টেশন কমান্ডারকে আমাদের গন্তব্য এবং টার্গেট সম্পর্কে বলা হল। সে বলল রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষকে আমি চিনি, তোমরা চাইলে আমরা যোগাযোগ করতে পারি। আমাদের সাথে প্রিস্টিনা থেকে অভিযানে অংশ নেয়া কেপিএস কমান্ডার কার্ণেল সুলেমান ও তেমনি মতামত দিল।
আমাদের সাথে থাকা ইউএন সিকিউরিটি টিমের সাথেও কথা বললাম। সে বলল কেপিএস এর অফিসার যোগাযোগ করতে পারে। মিলিটারি কনভয় কমান্ডার বললো তোমরাই operational entity, তোমরা যেভাবে চাইবে আমরা সেভাবেই কাজ করব তোমাদেরকে সাপোর্ট দিবো।
UN এর policy হল যতটা সম্ভব কম শক্তি প্রয়োগ করে কার্য্যসিদ্ধি করা। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে বিরেল রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তাদের কাছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধের চেতনাও থাকে। কাজেই গুলি বর্ষন করাটা তাদের কাছে কোন অপরাধ নয়, কিল ঘুষির মত নৈমিত্তিক ব্যাপার।
কেপিএস কমান্ডারের মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন কমান্ডার কে আমরা রেস্টুরেন্ট কতৃপক্ষ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে যোগাযোগ করার এজাজত দিলাম। সে মোবাইল ফোনে রেস্টুরেন্ট কতৃপক্ষ এবং দুয়েকজন স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানালো যে, ওখানে সম্ভবত বিবেলদের একটি অংশ মনে করেছে বিবেলদের অন্যপক্ষ তাদের কে আক্রমন করতে গাড়ীর বহর নিয়ে এসেছে ভেবে তারা ফায়ার ওপেন করেছে। ইউএন এর বহর এটা তারা বুঝতে পারেনি। ইউএন এর গাড়ীতে যদিও অনেক বড় করে কালো বা লাল হরফে ইউএন লেখা থাকে কিন্তু ছয় সাতশো মিটার থেকে তা দৃষ্টি গোচর হওয়ার কথা কিনা সে বিষয় আমরাও নিশ্চিত ছিলামনা।
আমরাও তাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের সাথে থাকা মিলিটারি কনভয় কমান্ডার আমাদেরকে এরিয়াল সাপোর্টদেয়া ইউক্রেন এয়ার উইং এর সাথে যোগাযোগ করেন মিলিটারি কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট সেন্টের মাধ্যমে। তারা মিনিট দশ পনেরো পাহাড়ে চক্কর দিয়ে আমাদেরকে এরিয়াল ক্লিয়ারেন্স দিল।
অতঃপর ইউএন সিকিউরিটির সাথে পরামর্শ করে আমরা আবার কনভয় স্টার্ট করলাম। এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ী রাস্তা। মিলিটারী কনভয়ের ডায়মন্ড ফর্মেশান বারবার নষ্ট হচ্ছিল। কারন পাশাপাশি দুটি গাড়ী চলার মত চওড়া ছিলনা রাস্তা। সৈনিকরা নেমে গাড়ীর দুপাশ দিয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে হাটতে লাগল। সামনে থাকলো মেশিনগান লাগানো মিলিটারী পিকআপ। কেপিএসের দুটি গাড়ী ছিল আমাদের সাথে। একটি গাড়ী অর্থাৎ লোকাল পুলিশের স্টেশন কমান্ডার আগে রেষ্টুরেন্টে গিয়ে আমাদেরকে ক্লিয়ারেন্স দিলেন। তারপর আরো দশ পনেরো মিনিট ওয়েট করে আর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমরা রেস্টুরেন্টে গেলাম।
পাহাড়ের শুরুতেই রেষ্টুরেন্টটির অবস্থান। এরপরেই ২৫/৩০ কিলোমিটার জুড়ে পার্বত্য জনপদ। পাহাড়ের ঢালে ৫/৭ টি কটেজে রেষ্টুরেন্টের কার্য্যক্রম চলে। নীচে সমতলে সান বাধানো কয়েকটি চাতাল এবং তার মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা কৃত্রিম নহরে মাছ ছেড়ে দেওয়া। স্বচ্ছ পানিতে ক্রীড়ারত নানা রঙের মৎস্যরাজি, লাল সাদা, কালো, নীলও। একটা পন্ডে নানা প্রজাতির ব্যাঙ, কচ্ছপ,শামুক ও আছে।
গেস্টরা ঘুরে ঘুরে মাছ দেখে অর্ডার দেয়। বাশের মাখায় নেট লাগানো নলিতে রেষ্টুরেন্টের স্টাফরা সেই মাছ ধরে গেষ্টের পছন্দ মত ফ্রাই, বারবিকিউ বা বয়েল করে স্পাইস দিয়ে দেয়। সাথে আছে রেস্টুরেন্টের নিজস্ব ফার্মে উৎপাদিত ফ্রেশ ভেজিটেবল। একসাথে শতাধিক লোক বসে খেতে পারে।
কাস্টমার আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা, পাহাড় বসবাসরত স্বচ্ছল কৃষকরাও রেষ্টুরেন্টের কাস্টমার হয় মাঝে মাঝে। শীতের ৩/৪ টি মাস বাদ দিলে এ অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে। পাহাড় চুড়ায় জমে থাকা বরফ ঝর্না হয়ে বা ছোট ছোট নালা হয়ে নেমে আসে ভ্যালিতে, সমতলে। শীতে বরফে চাপা পড়া তৃনরাজি মরে পচে শুকিয়ে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দেয় বহুগুনে। ফলে প্রচুর আপেল, কমলা, নাশপাতি, পিচ ফল যেমন হয় তেমনি নানা ধরনের সবজিও জন্মে প্রচুর।
পাহাড়ের পাদদেশেই ছোটখাটো একটি পাহাড়ী বাজার। মূলত: বিভিন্ন ব্রিউয়ারির পারচেজ সেন্টার আছে কয়েকটা। কসোভোর স্থানীয় বাসিন্দারা আপেল কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে তার পর জাল দিয়ে এক ধরনের ঘন পেস্ট তৈরী করে। এই পেস্ট ব্রিউয়ারি বা মদের কারখানায় প্রসেসিং হয়ে তৈরী হয় দামী দামী ওয়াইন। ওয়াইন কোম্পানী গুলো স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে ম্যানুয়ালি জাল দেয়া আপেলের ঘন দ্রবন বেশ ভাল দামেই কিনে। পাহাড়ী এ বাজারটি আপেল পেস্ট কেনা বেচার জন্য বিখ্যাত। সামারে পাহাড়ের ঢালে, পাহাড় সংলগ্ন সমতলে প্রচুর আনারস এবং কলাও হয়। সেটাও বাজার টি জম জমাট হওয়ার অন্যতম কারণ।
সকাল ১১ টা নাগাদ আমরা যেখানে পৌঁছি। বাজারের এক পাশে কৃষকদের উৎপাদিত পন্য বিক্রির জন্য কৃষকরা তাদের ভাঙ্গা চোরা Audi বা স্টেশন ওয়াগনের পিছনে সংযুক্ত আলাদা ট্রলিতে তাদের উৎপন্ন কৃষি পন্য বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছে। টমেটো, ক্যাপসিক্যাম, ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাল সাদা র্যাডিশ, আপেল, নাশপাতি, পীচফল, পেয়াজ, লেটুস পাতা, কলা, এমন সব পন্যের বিশাল বাজার। ক্রেতা বিক্রেতা মিলে দুতিনশো লোক আছে বাজারে। রাস্তার পাশে বেশ কয়েযকটি ওপেন রেস্টুরেন্ট চলছে কাবাব, ভেজিটেবল, চিকেন বারবিকিউ, কফি, বিয়ারের দোকান। আমাদের দেশে গ্রামের বাজারে যেমন করে জিলাপী, সিংগাড়া বা পেয়াজু ভেজে বিক্রি হয় এখানেও তেমনি হচ্ছে। পাহাড়ী অধিবাসী যাদের বেশীর ভাগই নারী, ছই দেওয়া ভ্যানের উপর গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে ভাজছে নানা পদের লোভনীয় সব খাবার। একটা দোকানে দেখলাম আমাদের দেশের ফুলকপির চপের মত করে ডুবো তেলে ভাজছে ফুল কপি, গাজরের চাপ।
বাজার ঘুরতে ঘুরতে আমরা ভুলে গেলাম একটু আগের উত্তেজনা। আমার গাড়ীতেই ছিল ল্যাংগুয়েজ এসিটেন্ট এন্টনি। সে অনেক দিন ধরেই আমার সাথে। সে আমার চোখের ভাষা অল্প বিস্তর বোঝে। সে অনেকগুলো চপ নিয়ে গাড়ীতে উঠল। গ্লাস উঠিয়ে টেস্ট করে দেখলাম দুর্দান্ত তার স্বাদ। একেবারেই আমাদের দেশের রোজার মাসে ইফতারির সময় যে ফুলকপির চপ বানানো হয় তেমনি থেকে।
যাহোক বাজারে একটা চক্কর দিয়ে রেষ্টুরেন্টে গিয়েই বসলাম। কসোভো পুলিশের স্থানীয় কমান্ডার বেশ কারিৎকর্মা লোক। তাকে আমরা রাস্তাতে থাকতেই আগমনের উদ্দেশ্য বলেছি। সে স্থানীয় কমিউনিটির লোকজনকে হাজির করে ফেলেছে। দিনটিও ছিল স্থানীয় হাটবার। সেখানে সপ্তাহে শনি এবং মঙ্গলবার এ দুদিন হাট বসতো। হাটবার হওয়াতে কাঙ্খিত লোকজন বেশীল ভাগ বাজারেই ছিল।
পেপারটি ইনভেস্টিগেশনের দায়ীত্ব প্রাপ্ত আমাদের ইউনিট এসআইটি এর অফিসার রাশিয়ান পুলিশ অফিসার সের্গেই রহিমভ তার টিম নিয়ে তার কাজ শুরু করল। কাজ মানে বিভিন্ন লোকের ইন্টারভিউ নেয়া। এরপর সে থানা এবং চার্চে গিয়ে তাদের রেজিষ্টার মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করবে বর্ণিত ঐ অপারেশনে কতজন মারা গেছে তাদেরকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে ইত্যাদি খোঁজ নেয়ার জন্য। ভিকটিম পরিবারের সদস্যরা আগে থেকেই জানতো যে ইউএন টিম আসবে। যদিও কবে আসবে তা তারা জানতো না। ল্যাংগুয়েজ এসিটেন্ট এবং কেপিএস সদস্যদের মাধ্যমে ফোনে সংবাদ পেয়ে অনেকেই ইতিমধ্যে হাজির হয়েছে। তারা তো এমনিতেই ইন্টারেস্টেড পক্ষ। কারন মৃতের খাতায় নাম লেখাতে পারলে তাদের পরিবার পাবে শহীদ পরিবারের মর্যাদা এবং তারা ইউএন বা ইউ কর্তৃক নানা আর্থিক সুবিধাদিও পাবে। কাজেই দরখাস্তে আবেদনকারী হিসাবে যাদের নাম লেখা হয়েছে তাদের বেশ অনেককেই পাওয়া গেল এবং তারা সবাইই প্রায় একই রকম স্টেটমেন্ট দিল যে, ২০০০ সালের এমনি এক হাটবারে তাদের পরিবারের সদস্যরা এই রেষ্টুরেন্ট বসে লাঞ্চ করছিল। বেলা তিনটায় কেএলএ এর একটি গ্রুপ এসে তাদের উপর অতর্কিত হামলা করে।
হামলাকারীদের ধারনা ছিল এই শস্যভান্ডার থেকেই সার্বিয়ান আর্মি তাদের ফ্রেশ ভেজিটেবল বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়, এমনকি সার্বিয়ান আর্মির ঘাটিতে এখান থেকে নিয়মিত স্থানীয় তৈরী ওয়াইন সরবরাহ করা হয়। তখন যুদ্ধ শেষ।
কে এল এ কসোভো লিবারেশন আর্মির দাপটই বেশী, সার্বিয়ান আর্মি ফিরে গেছে সার্বিয়ায়। কাজেই স্থানীয় অধিবাসীরা আলবেনিয়ানদের অতর্কিত সে হামলায় টিকতে পারেনি। এক পর্যায় তারা রেস্টুরেন্টের বারে ব্রাশাফায়ার করে এবং যেখানে অনেকেই মারা যায়। যাদেরকে স্থানীয় চার্চে সমাহিত করা হয়। স্থানীয় লোকজন মোটামুটি একই রকম বক্তব্যই সবাই দেয়। তাদের স্টেটমেন্ট অডিওতে ধারন করা হয়, লিপিবদ্ধ করে সবার স্বাক্ষর নেয়া হয়। এরপরের কাজ থানায় রেকর্ডপত্র যাচাই করা এবং চার্চ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা।
রেষ্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের লাঞ্চ করার জন্য ইনভাইট করে। ইউএন এর প্রটোকল অনুযায়ী ইন্টারেস্টেড কোন পক্ষের সাথে অপ্রয়োজনীয় খাতির করা জায়েজ নাই। তখন লাঞ্চের হাই টাইম এবং পরে আমাদেরকে থানা এবং চার্চে যেতে হবে। আশেপাশে লাঞ্চ করার মত কোন ভাল জায়গাও নেই। প্রটোকল অনুযায়ী বিশেষ ক্ষেত্রে বিল পরিশোধ সাপেক্ষে খাদ্য পানীয় এবং গাড়ীর জ্ববালানী সহ অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করার সুযোগ আছে। যে যার পছন্দের খাবারের অর্ডার দিয়ে রেষ্টুরেন্টটা ঘুরে দেখলাম।
মূলতঃ স্থানীয় বাজারের ক্রেতা বিক্রেতাদের জন্য রেস্টুরেন্টটির গোড়া পত্তন হলেও দাম স্থানীয় বাজারের প্রায় দ্বিগুন হওয়ায় মূলতঃ অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী বা কৃষকরাই এখানে আসে। ডিনারের জন্য এটি স্থানীয় স্বচ্ছল অধিবাসীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় একটি ফ্যামিলি ভেন্যু। ২০/৩০ বিঘা জায়গা জুড়ে রেষ্টুরেন্টটির অবস্থান। মাঝখান দিয়ে কনক্রিটের রাস্তা। লোকটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে শেডগুলোর পাশ ঘেঁষে।
বেশ দূরে দূরে অবস্থিত টালির ছাদের শেডগুলিতে কাস্টমাররা বসে লাঞ্চে বিজি। শেড এবং রাস্তার মাঝখানে সবুজ লন। লনের সবুজ ঘাসে স্থানীয় কারিগরদের তৈরী প্রাচীন গ্রীক স্কাল্পচারের নিদর্শন নগ্ন নারী মূর্তি, লেকে জলকেলিতে ব্যস্ত মৎস্য কন্যা এমন সব অনবদ্য শিল্পকর্ম। বেশীর ভাগই নগ্ন নারী মূর্তি। মাঝে মাঝে আপেল, নাশপাতির গাছ। সারিসারি পাইন, থুজা বা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি।
রেষ্টুরেন্টটি এক চক্কর দিয়ে এসে আমাদের নির্ধারিত শেডে বসলাম। কেপিএস কমান্ডার আমার খাবার রুচি জানে। আমার অনুরোধে সেই অর্ডার দিয়েছে ভেজিটেবল স্যুপ, ফ্রেশ ভেজিটেবল মিক্স, তেলাপিয়া ফ্রাই আর আনারসের চাটনি। ড্রিংক্সস হিসাবে ফ্রেশ টমেটো এবং আপেল জুস এবং খাবার শেষে পাহাড়ী ছাগলের দুধের মশলা চা।
এই এক কিমতি জিনিস। জিলানে বেড়াতে গেলে আমাদের এক সাব ইন্সপেক্টর প্রথমে আমাকে এই বিশেষ চা খাওয়ায়। পাহাড়ী ছাগল বা ভেড়ার (সাদা ছাগল) দুধ বেশী করে জ্বাল দিয়ে অনেকটা মালাই চা এর স্টাইলে এই চা বানানো হয়। এর সাথে যার যার পছন্দ মত ফ্লেভার যেমন এলাচ, দারু চিনি, স্ট্রবেরী ফ্লেভার দেয়া হয়। প্রথম প্রথম একটু গন্ধ লাগে কিন্তু একবার গা সওয়া হয়ে গেলে ফাস্টোকেলাস।
প্রিস্টিনা শহরে এ জিনিষ আমার চোখে পড়েনি কোথাও। শুনেছি ওপেন মার্কেটগুলোর আশেপাশের কমদামী রেষ্টুরেন্টে পাওয়া যায়। যাওয়া হয়নি কখনো। তবে প্রিস্টিনার বাইরে গেলে ছাগল বা গরুর দুধের মশলা চা ছিল আমার অনিবার্য চয়েজ।
যাহোক লাঞ্চ সেরে জোরাজুরি করে বিল দিয়ে থানা এবং চার্চে গেলাম তাদের রেকর্ড কালেকশন করার জন্য। থানায় আমাদের মূল দেখার বিষয় ছিল ঘটনার অব্যবহিত পরে থানা থেকে রিজিওনাল হেডকোয়ার্টার্সে ইলেকট্রনিক ওয়েতে পাঠানো ট্রান্সক্রিপশন রিপোর্টের কপি। যুদ্ধের কারনে অনেক জায়গায় অনেক রিপোর্ট বা রেকর্ড নষ্ট হয়ে গেলেও আমরা সন্তুষ্ট হওয়ার মত রিপোর্ট পেলাম। ঘটনার পর দিনই ২৬ জনের মৃত্যুর রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে সে রেকর্ড পেলাম। দরখাস্তে উল্লিখিত ছিল ৪২ জনের। বাকীদের আত্মীয় স্বজনদের বক্তব্য মতে ওরা তাৎক্ষনিকভাবে নয় পাহাড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা গেছে। যুদ্ধবস্থার কারনে পুলিশকে রিপোর্ট করা হয়নি। তবে স্থানীয় অর্থোডক্স চার্চে তাদের অন্তস্ট্রিক্রিয়া হয়েছে।
পরবর্তী গন্তব্য স্থানীয় অর্থোডক্স চার্চ। পাহাড়ের পথে অবস্থিত চার্চটি প্রায় একশো বছরের পুরানো। পাহাড়ের ঢালেই মূল চার্চটি। সামনে বিরাট খালি জায়গা, এখানে সেখানে এলোমেলোভাবে দুয়েকটি শেড। ষাটোর্ধ লাল টুকটুকে প্রিস্ট আমাদের রিসিভ করলেন। এ অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রায় সবাই অর্থোডন্স খ্রীষ্টান। ধর্মীয় বিশ্বাস মতে অন্তষ্ট্রিক্রিয়া না হলে আত্মার ভয়ানক কষ্ট হয়। কাজেই মৃতের পরিবার বা বন্ধুরা অবশ্যই চায় যেন শেষ কৃত্যটি হয়। এখনোও পেলাম বেশ কিছু মূল্যবান ডকুমেন্ট। আ/স
লেখক: এডিশনাল ডিআইজি
এন্টি টেরোরিজম ইউনিট
টাইম লাইন থেকে সংগৃহিত