সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটুট থাকবে।দুর্নীতির বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনায় দেশজুড়ে চলছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। যত প্রভাবশালী এবং সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, ছাড় পাচ্ছেন না কোনো অপরাধীই। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ সরকার ও দল। সরকারের এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সুশীল সমাজসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতিগুলোতেও অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রতিফলন রয়েছে। সর্বশেষ গত ৯ জুলাই জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। কে কোন দলের তা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি। ধরে যাব।’ এর আগের দিন সংসদে আরেক বক্তৃতায় করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্রতারণায় যুক্ত রিজেন্ট হাসপাতাল ও এর চেয়ারম্যান মো. সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই হাসপাতালের এই তথ্য আগে কেউ দেয়নি, জানাতে পারেনি। সরকারের পক্ষ থেকেই খুঁজে বের করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি।’ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, করোনা সংকট শুরুর পর থেকে বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি কঠোরহস্তে অনিয়ম-দুর্নীতি দমনে জোর দেন তিনি। তার নির্দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগে থেকেই চলে আসা অভিযান নতুন মাত্রা পায়। এরই মধ্যে মানব পাচারে অভিযুক্ত স্বতন্ত্র এমপি শহীদ ইসলাম পাপুলের কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে দলের কয়েকজন নেতা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়।
সর্বশেষ গতকাল রোববার দুর্নীতির ফাইলের খোঁজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই দিন দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) তিন কর্মকর্তাকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অন্যদিকে অনুমতি ছাড়া করোনা ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অভিযোগে গতকালই রাজধানীর সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তাকে আটক করা হয়।
করোনাকালে এখন পর্যন্ত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সবচেয়ে আলোচিত দুটি ঘটনা হচ্ছে করোনার সনদ জালিয়াতিসহ নানা প্রতারণায় জড়িত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম এবং জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা। সাহেদের বিরুদ্ধে করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ছয় হাজার এবং আরিফ-সাবরিনা দম্পতির বিরুদ্ধে ১৫ হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এ দুই প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে করোনা পরীক্ষার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেই এমন প্রতারণা চালিয়ে আসছিল। অভিযানকালে শুধু সাহেদ ও আরিফ-সাবরিনাই নন, তাদের অনেক সহযোগী গ্রেপ্তার হয়েছেন। বন্ধ হয়েছে অনিয়মে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলা করার পাশাপাশি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অন্যান্য আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতারক সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পরিচয় দিয়ে সরকার ও দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন। মন্ত্রী ও নেতানেত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে অপব্যহারের মাধ্যমে প্রতারণার জাল বিস্তার করে আসছিলেন তিনি। অবৈধভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক বনে যান সাহেদ। তবে দলীয় পরিচিতি কিংবা এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’- কোনো কিছুতেই শেষরক্ষা হয়নি তার। সাঁড়াশি অভিযানের মুখে ৯ দিন আত্মগোপনে থাকার পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সাতক্ষীরা সীমান্তে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন সাহেদ। নানা অসাধু উপায়ে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন সাবরিনা-আরিফও। তাদেরও শেষরক্ষা হয়নি।
এদিকে, করোনা পরীক্ষা, পিপিই ও কিট সরবরাহ নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া স্বাস্থ্য খাতের কয়েকজন হর্তাকর্তার বিরুদ্ধেও নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। করোনাকালে ত্রাণ তৎপরতায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদেরও তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করে কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এসব জনপ্রতিনিধির বেশিরভাগ ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত।
সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুল মানব পাচারে অভিযুক্ত হয়ে কুয়েতে গ্রেপ্তারের ঘটনায়ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পাপুল ও তার স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান, ব্যাংক হিসাব এবং স্ত্রী-শ্যালিকাসহ অনেকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সংসদে বলেছেন, ‘ওই সংসদ সদস্য (পাপলু) কুয়েতের নাগরিক কিনা, তা নিয়ে কুয়েতের সঙ্গে কথা বলছি। বিষয়টি দেখব। যদি এটা হয়, তাহলে তার ওই আসনটি (লক্ষ্মীপুর-২) খালি করে দিতে হবে। যেটা আইন আছে, সেটাই হবে। আর তার বিরুদ্ধে এখানেও তদন্ত চলছে।’
পাপুল-সাহেদ-সাবরিনা ছাড়াও অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত আরও অনেকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদবির-বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক বনে যাওয়া পাপিয়া নামের এক যুব মহিলা লীগ নেত্রীকে গ্রেপ্তার ও জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থান আগে থেকেই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বিশেষ করে চলতি মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই নির্বাচনী ইশতেহারের ‘দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। সরকার ও দলের মধ্যেও এমন নীতির প্রতিফলন ঘটান তিনি। আগে থেকে চলে আসা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকবিরোধী অভিযানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার হয়ে ওঠে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশজুড়ে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের শুদ্ধি অভিযানের সূচনা ঘটিয়ে এ বিষয়ে তার কঠোর অবস্থানের ‘বার্তা’ তুলে ধরেন।