করোনা নয়, হঠাৎ করেই আগস্টের শুরু থেকে দেশের হাসপাতালগুলোতে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। যা পুরো দুই মাস আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে কমতে শুরু করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। ৩০ সেপ্টেম্বর যা শতাংশের হিসেবে ৩-এর নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ শতাংশের নিচেই অবস্থান করছে। একই সময়ে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির হার না কমলেও অক্টোবরের শুরু থেকে কমেছে এ চাপ।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় ডেডিকেটেডসহ প্রায় সবগুলো হাসপাতালেই দুই দিনে রোগী ভর্তি কমেছে। ফলে হাসপাতালগুলোতে বিরাজ করছে স্বস্তি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ডেঙ্গু বা করোনা অন্যান্য দেশের মতো মহামারী রূপ নিতে পারেনি বাংলাদেশে।
বর্তমানে দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক বলে মন্তব্য করেছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরও। রবিবার করোনা বিষয়ক নিয়মিত বুলেটিনে অধিদফতরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) অধ্যাপক ডাঃ মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিবেচনায় করোনার সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক। গত দু-তিন সপ্তাহে অব্যাহতভাবে সংক্রমণ কমছে, যা স্বস্তি ফিরিয়ে আনছে সবার মনে। তিনি বলেন, এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৪ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এ স্বস্তিকর অবস্থা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মেনে চলা প্রয়োজন ও সবার চেষ্টায় সংক্রমণের হার আরও কমানো সম্ভব।
স্বস্তি এসেছে ডেঙ্গু রোগী ভর্তিতেও। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা ঢাকা শিশু হাসপাতালে শনিবার ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট শিশু ভর্তি হয়েছে ৩৬ জন। এরপর থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও কমছে। এর আগের সপ্তাহেও যেখানে ৭০ জনের বেশি রোগী ছিল সেখানে রোগী ভর্তি তুলনামূলক কমেছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ শফি আহমেদ নাগরিক খবরকে বলেন, সেপ্টেম্বরের পুরোটা মাস যে ভয়াবহ অবস্থায় কেটেছে তা অনেকটাই কমেছে গত দুই দিনে। আশা করছি এই সপ্তাহের মধ্যেই এ সংখ্যা আরও কমে যাবে।
একই স্বস্তির কথা জানান ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসায় ডেডিকেটেড মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মোঃ রশিদ-উন-নবী।নাগরিক খবর কে বলেন, পুরোপুরি না কমলেও সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরের শুরুতে রোগী ভর্তির চাপ একটু কম। আগে যেখানে ২৫০ থেকে ২৬০ জন রোগী প্রতিদিন ভর্তি হতো এখন সেখানে ১৭০ থেকে ১৮০ জন ভর্তি হচ্ছে। যেহেতু বৃষ্টির সম্ভাবনা এই মাসে খুব কম। তাই ডেঙ্গুর লার্ভা বিস্তারের সুযোগও কম। তাই আশা করছি এ সংখ্যা আরও কমবে।
ডেঙ্গু এবং করোনায় আক্রান্ত উভয় রোগী ভর্তির সংখ্যাই কমেছে দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক নাগরিক খবরকে বলেন, আগে যেখানে প্রতিদিন ৯শ’র ওপরে রোগী ভর্তি হতো প্রতিদিন এখন তা কমে ৪শ’র নিচে চলে এসেছে। প্রতিদিন কমছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু রোগীও তুলনামূলক কম। এর পুরোটাই সম্ভব হয়েছে চিকিৎসক-নার্সসহ হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য। আমরা ইতোমধ্যে সরকার ঘোষিত তাদের বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিয়েছি। তবে তাদের প্রাপ্য আরও বেশি।
আশাতীত রোগী ভর্তি কমেছে করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এ কে এম মুজিবুর রহমান বলেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যেখানে সর্বোচ্চ ৫শ’র মতো রোগীও একদিনে ভর্তি হয়েছে সেখানে এখন দৈনিক ৭৩ থেকে ৭৬ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগী তো আরও কম। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সত্যি আমাদের স্বস্তি বাড়বে। তবে করোনাকালে দিনরাত রোগীদের চিকিৎসা করলেও সরকার ঘোষিত কোন প্রণোদনা পাওয়া তো দূরে থাক নিয়মিত বেতন-ভাতাই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন হাসপাতালে কর্মরত আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োজিত তৃতীয় শ্রেণীর কর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী জানান, মাঝে মাঝেই শুনি যে প্রণোদনার জন্য তালিকা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই পাইনি। এমনকি কোম্পানির সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে নিয়মিত বেতন-ভাতাও পাচ্ছি না। এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করে পরিচালক বলেন, এমন কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। সরকারী হাসপাতালে তো এরকম বেতন-ভাতা অনিয়মিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। যারা এসব বলছে তারা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা কথা বলছে।
তবে করোনাকালীন সময়ে চিকিৎসকরা যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা কোন কিছুর বিনিময়ের আশায় নয় দাবি করে করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার বলেন, দেশে করোনা শুরুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিজের জীবন বাজি রেখে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণে মোট নয় হাজার ৪২৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে তিন হাজার ১১৯ জন চিকিৎসক, দুই হাজার ২৮১ জন নার্স এবং চার হাজার ২৫ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। শুধু তাই নয় এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ১১৯ জন চিকিৎসক। সারাদেশের জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকা জেলায় ৮৬৫ জন।
এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় ৪৯২ জন, সিলেট জেলায় ৩৪৯ জন, ময়মনসিংহে ১৪৩ জন, কুমিল্লায় ১৩১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা দুই হাজার ২৮১ জন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায় ৮৩২ জন, এরপর ১৬৪ জন ময়মনসিংহে, ৮৯ জন বরিশাল জেলায়। এছাড়াও চার হাজার ২৫ জন অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট নয় হাজার ৪২৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। সরকার প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে আমাদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব প্রণোদনা কাজের উৎসাহ দ্বিগুণ করে দেয়। আশাকরি ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। নিজের হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা অনেকটাই কমেছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, তবে এর জন্য আমাদের এতটা স্বস্তির কোন কারণ নেই।
টিকা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নতুন করে আরও টিকা আসছে বিভিন্ন উৎস থেকে। কিন্তু এরপরও আমাদের স্বাস্থ্যবিধি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে মানতে হবে।এর বিকল্প কিছু নেই। তেমনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের নিজেদের বাসা-বাড়ি আঙ্গিনা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যাতে ডেঙ্গুর লার্ভা জন্ম নিতে না পারে। এতে করে ডেঙ্গুর সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৮৪১ জন, যা চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এর আগে আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সাত হাজার ৬৯৮ জন। শুধু সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। তবে এ অবস্থা অক্টোবরে থাকবে না বলে জানিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, মানুষের মধ্যে দিন দিন সচেতনতা বাড়ছে। আর এতে করে আমরা দেখছি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমেছে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
এদিকে অক্টোবর মাস প্রাকৃতিকভাবেও ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশার প্রজননের মাস নয়। তাই আশা করছি ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যেই ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তিনি বলেন, এই দুই বছর আমাদের চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবাই নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন উজাড় করে। নিজের পরিবার-প্রিয়জন ছেড়ে দিনের পর দিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে। তাদের জন্য সরকার নানামুখী প্রণোদনা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। তবে সবাই এটি পেয়েছে কি না তা ঠিকঠাকভাবে তদারকি করতে হবে দায়িত্বশীলদের।