জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার জন্য প্রধানমন্ত্রী আবারও জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল সেটাও একদিন বের হবে দুঃখজনক হলো, নিজের দলের ভেতরে খন্দকার মোশতাকও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে আবারও অভিযুক্ত করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, তবে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা সেটা এখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে সেটা একদিন না একদিন আবিষ্কার হবে এটা ঠিক। ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল সেটাও একদিন বের হবে।রক্তাক্ত-শোকাবহ শোকের মাস আগস্টের প্রথম দিন রবিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতার স্মৃতি জাদুঘর সংলগ্ন এলাকায় বাংলাদেশ কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্ত ও প্লাজমা দান কর্মসূচীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমার অবাক লাগে যে, এর (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড) সঙ্গে আমাদের যারা, তারা কি করে জড়িত থাকল? আমাদের কাজ একটা ছিল- প্রত্যক্ষভাবে যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার করা। আর সব থেকে বড় কাজ এই দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- সেই দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। তার (জাতির পিতার) রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে।বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। তবে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, একদিন সেটাও আবিষ্কার হবে। দেশের উন্নয়ন করাটাকেই আমি সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। তাই পেছনে কে ষড়যন্ত্র করেছে, কি করেছে- সেদিকে না গিয়ে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে এই ক্ষুধার্ত, দরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন করে তাদের জীবনমান উন্নত করা।আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাবা-মা, ভাই সবাইকে হারিয়েছি। তবুও একটা আদর্শকে ধারণ করেই পথ চলি। এটাই আমার শক্তি। যে স্বপ্নটা আমার বাবা দেখেছিলেন, ছোটবেলা থেকে তার মুখে যে কথাগুলো শুনেছি, সেটাকে আমার বাস্তবায়ন করতে হবে। এর বাইরে আর কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাই, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন দেখতে চাই। বাংলাদেশ ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে গড়ে উঠবে, বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবে, মর্যাদা নিয়ে চলবে, সম্মানের সঙ্গে চলবে। আমরা বিজয়ী জাতি, বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।কৃষক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দের সভাপতিত্বে ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী প্রমুখ। অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বেগম মতিয়া চৌধুরী দুস্থ কৃষকদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।কর্মসূচীর উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা ধাপে ধাপে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। কিন্তু পাকিস্তানী শাসক চক্র বা এ দেশের কিছু পাকিস্তানী দালাল চক্র বা তাদের খোশামোদী, তোষামোদকারী,
তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেকে এই ধরনের মতামত দিয়েছিল যে, এটা আমাদের জন্য একটা বোঝা ছিল, চলে গিয়েছে ভালই হয়েছে। এরা (বাংলাদেশের মানুষ) তো আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পাকিস্তানী সেই সমস্ত লোক তাদের যে মতামত আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের চিন্তা-ভাবনা, কার্যক্রম যদি পর্যালোচনা করেন তাহলে দেখবেন সব একই, তাদের মধ্যে মিলে যায়। তারাও ভেবেছিল এই বাংলাদেশ কোনদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ার তাদের কোন পথ ছিল না। উপরন্তু খুনীদের পুরস্কার হিসেবে জিয়াউর রহমান তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। খুনীদের পুরস্কার হিসেবে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি, ব্যবসার সুযোগ ও বিপুল অর্থের মালিক করে দেন এই জিয়াউর রহমান।
’৯৬ সালে ২১ বছর পর সরকারে এসে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের মাধ্যমে তার সরকার এই হত্যাকা-ের বিচারের সমস্ত বাধা দূর করে বিচার কাজ শুরু করে এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর সেই বিচার সম্পন্ন করতে সমর্থ হয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ’৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জাতির পিতা হত্যাকা-ের বিচারের রায় ঘোষণার দিনেও হরতাল ডেকে সে সময় বিরোধী দলে থাকা খালেদা জিয়া বিচারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। যদিও সেই বিচারের রায় হয়েছিল এবং তার সরকার দু’জন খুনীকে আমেরিকা ও থাইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু পুনরায় খালেদা জিয়া ২০০১ সালে সরকারে এসে সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে আবারও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
তিনি বলেন, এমনকি, ৩ নবেম্বর যখন বিচারের রায় ঘোষণার তারিখ সুনির্দিষ্ট করা হয়, তারপরেও এক খুনীকে খালেদা জিয়া চাকরি ফিরিয়ে দেন এবং প্রমোশন দেন এবং পরবর্তীতে তাকে দূতাবাসেও চাকরি দেন। কারণ, প্রমোশন দিয়ে খালেদা জিয়া মনে হয় এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, এই খুনীদের বিচার করা যাবে না।
একজন খুনী মৃত্যুবরণ করেছিল সেই মৃত ব্যক্তিকেও খালেদা জিয়া প্রমোশন দেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ডিসমিস করেছিল, তাই অবসর ভাতা দিয়েও তাকে পুরস্কৃত করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময় জাতির ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল, সেই ভাষণও আজ বিশ্বের সবচেয়ে উদ্বুদ্ধকারী একটি ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের ওপর জাতির পিতার অগাধ বিশ্বসের প্রসঙ্গ টেনে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট যখন খবরটা পাই আমরা কিছুতেই তা বিশ্বাস বা ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশের মানুষের ওপর আমার বাবার অগাধ বিশ্বাস ছিল।
তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন, বাঙালী কখনও তার গায়ে হাত দিতে পারবে না। আর পাকিস্তানীরা যখন চেষ্টা করে তাকে হত্যা করতে পারেনি, আর বাঙালীরা কেন মারবে? অনেকেই অনেকভাবে বঙ্গবন্ধুকে খবর দিয়েছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কখনও বিশ্বাস করেননি। কোন রাষ্ট্রপ্রধান-সরকারপ্রধান বলেছেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) একটা কথাই বলেছেন- এরা আমার সন্তানের মতো। এরা কেন আমাকে মারবে? জাতির পিতার সেই বিশ্বাসে চরম আঘাত দিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমরা সরকার গঠন করলাম। তখন থেকেই আমাদের প্রচেষ্টা ছিল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা যে রূপকল্প দিয়েছিলাম, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করব। আজকে বাংলাদেশ আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি। এখন জাতির পিতার ১০১তম জন্মবার্ষিকী।
পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের যে উন্নয়নের গতিধারাটা এটা হয়তো আমরা আরও অব্যাহত রাখতে পারতাম। যদিও করোনা নামক মহামারী না দেখা দিত।
সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শোক দিবসের কর্মসূচী পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনায় শুধু আমাদের না, সারাবিশ্বব্যাপী আজকে অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের ভোগান্তি শুরু হয়েছে। তার থেকে আমরাও মুক্ত না। তবুও আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। করোনার ভয়াল থাবা সত্ত্বেও মানুষের খাদ্যের এবং তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা সরকার করে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে ।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীর সাফল্যে কামনা করে বলেন, এই রক্তদানের মাধ্যমে আমরা একজন মুমূর্ষু রোগীকেও যদি বাঁচাতে পারি, সেটাই হবে সব থেকে বড় কথা। কেননা মানবকল্যাণে আপনি রক্ত দান করছেন। জাতির পিতা আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, যে আদর্শের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, বঙ্গবন্ধু তো এটাই চেয়েছিলেন যে, তাঁর দল (আওয়ামী লীগ) মানুষের পাশে থাকবে, দুর্যোগে মানুষের সঙ্গে থাকবে, মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে সেই কাজটিই করে যাচ্ছে।