স্থানীয়ভাবে লকডাউন ও বিশেষ বিধিনিষেধে কাজ হচ্ছে না। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বাড়তে থাকা করোনার সংক্রমণ অন্যান্য জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারও খারাপ হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল বুধবার ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে করোনায় ৬০ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে। এর আগের দিন মারা গিয়েছিলেন ৫০ জন। এক দিনের ব্যবধানে শনাক্ত রোগীও বেড়েছে। মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৪ হাজার জনের। এর আগের দিন শনাক্ত রোগী ছিলেন ৩ হাজার ৩১৯ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা রোগী শনাক্ত, মৃত্যু ও শনাক্তের হার—তিনটি সূচকই প্রায় দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। এমন পরিস্থিতিতে চলমান বিধিনিষেধ আরও এক মাস বাড়িয়েছে সরকার। নতুন বিধিনিষেধের বিষয়ে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আগের ঘোষণা অনুযায়ী বিধিনিষেধ গতকাল মধ্যরাতে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ চলবে।
গত মাসের মাঝামাঝিতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর ভারতের সীমান্তবর্তী ১৫টি জেলায় রোগী দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ইতিমধ্যে ভারতে শনাক্ত হওয়া করোনার ধরন ‘ডেলটা ভেরিয়েন্টের’ সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে দেশে। ডেলটা ভেরিয়েন্টের কারণে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক বেড়েছে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন বুলেটিনে অধিদপ্তরের অন্যতম মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর, রাজশাহী, খুলনা, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, কুড়িগ্রাম, নাটোর এবং দিনাজপুর জেলায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রোগী শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। এক মাস ধরে সংক্রমণ একটু একটু করে বাড়ছে। তিনি বলেন, সীমান্তের জেলাগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যাগুলোতে চাপ বেড়ে চলেছে।এই মুহূর্তে করোনা চিকিৎসায় ঢাকা মহানগর বাদে ৭ হাজার শয্যা আছে। শনাক্ত রোগী ৮ হাজার ছাড়িয়ে গেলে রোগী ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে।
সংক্রমণ বাড়ছেই, ঢিলেঢালা লকডাউন
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশের ১৩টি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন অথবা বিশেষ বিধিনিষেধ জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে এসব এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, শনাক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে (সঙ্গনিরোধ) নেওয়া, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, খাদ্য ও সামাজিক সহায়তা, শতভাগ নাগরিকের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়গুলো পুরোপুরি নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ২ হাজার ২৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৮১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, যা খুলনা বিভাগে এক দিনে শনাক্তের নতুন রেকর্ড। এর আগে গত মঙ্গলবার এক দিনে ৮০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। এই বিভাগে নড়াইল বাদে অন্য সব জেলায় রোগী শনাক্তের হার ছিল ৩২ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে সাতক্ষীরায় শনাক্তের হার ছিল ৫৩ শতাংশের বেশি।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা জয়ন্ত সরকার জানান, প্রতিদিনই জেলায় করোনা সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালে করোনার তিনটি ওয়ার্ডে ৭৪টি শয্যার একটিও ফাঁকা নেই। হাসপাতালে আরও একটি ওয়ার্ড বাড়িয়ে ১০০ শয্যার করোনা ইউনিটে উন্নীত করা হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে শুধু কুষ্টিয়া নয়, পুরো খুলনা বিভাগেই কঠোর লকডাউন দেওয়া প্রয়োজন।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি রাজশাহীতেও। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছেন পাঁচজন। আটজনের মৃত্যু হয়েছে করোনা উপসর্গ নিয়ে।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নাটোর ও সিংড়া পৌরসভায় লকডাউন আরও সাত দিন বাড়ানো হয়েছে। গতকাল বর্ধিত লকডাউনের প্রথম দিনে শহরের প্রধান সড়কগুলোতে পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতা ছিল। জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ জানান, মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসন রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে। গতকাল শহরে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১২১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৬১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এটি সংক্রমণের শুরু থেকে জেলায় এক দিনে সর্বোচ্চ করোনা শনাক্ত। এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সাত দিন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে জেলা প্রশাসন।
নওগাঁয় চলমান বিধিনিষেধ আরও সাত দিন বাড়ানো হয়েছে। নওগাঁ জেলার করোনা প্রতিরোধ কমিটির ফোকাল পারসন ও ডেপুটি সিভিল সার্জন মঞ্জুর-এ মোর্শেদ বলেন, গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে নিয়ামতপুর উপজেলা ও নওগাঁ সদর উপজেলায় বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। তবে এক সপ্তাহ ধরে দেখা যাচ্ছে, পোরশা, সাপাহার, মহাদেবপুর ও পত্নীতলা উপজেলায়ও বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলায় লকডাউনের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল। জেলা শহরের মোড়ে মোড়ে নজরদারি করার জন্য চৌকি বসানো হলেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচল করেছে। মঙ্গলবার পুলিশ ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল আটক করায় গতকাল শহরে এসব যানবাহন চলাচল কিছুটা কমেছে। দিনাজপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুর জেলায় ১৯৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ৭৬ জন। শনাক্তের হার ৩৯ শতাংশ।
ঢাকাতেও রোগী বাড়ার শঙ্কা
গতকাল অনলাইন বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় এখনো শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তা ৬ শতাংশের নিচে। তবে সারা দেশে যদি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং আন্তজেলা চলাফেরা চলতে থাকে, তাহলে ঢাকাতেও রোগী বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯৫৬ জনের, যা গত ৫৫ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর চেয়ে বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল। সেদিন ৪ হাজার ১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩ হাজার ৮০৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। শনাক্তের হার এর থেকে বেশি ছিল গত ২০ এপ্রিল, ১৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের। এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল গত মে মাসের ৫ তারিখে, সেদিন মারা যান ৬১ জন।
এখন পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৮ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৭। মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ২৮২ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫২ জন।
বিধিনিষেধ বাড়ল এক মাস
দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সরকার এ বছর প্রথমে ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। পরে তা আরও দুই দিন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরে তা আরও সাত দফা বাড়ানো হয়েছিল। এবার একসঙ্গে এক মাস বাড়ানো হলো বিধিনিষেধ।
এবার বিধিনিষেধে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস খোলা থাকবে। এত দিন শুধু জরুরি সেবাসংশ্লিষ্ট অফিসগুলো খোলা রাখতে বলা হয়েছিল। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সবকিছুই খোলা।
নতুন বিধিনিষেধেও আগের মতোই সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান (বিবাহোত্তর সংবর্ধনা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানগুলো সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খাদ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করতে পারবে এবং আসনসংখ্যার অর্ধেক সেবাগ্রহীতাকে সেবা দিতে পারবে। অর্থাৎ হোটেলে বসে খাওয়া যাবে। সব ধরনের গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে।
বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ গতকাল বলেন, এখনকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি উত্তরণে চলাচল সীমিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁর মতে, এটা হতে পারে বাড়ির বাইরে চলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ বা এলাকার বাইরে বা জেলার বাইরে যেতে না দেওয়া। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়তে পারে।