সোহেল ইসলাম রানা। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। পরনে দামি ব্র্যান্ডের পোশাক। নামিদামি রেস্তরাঁর খাবার ছাড়া চলে না। চলাফেরা সরকারি স্টিকার সংবলিত দামি গাড়িতে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসে অবাধে যাতায়াত তার। নিজের অবস্থান জানান দিতে মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে প্রতিনিয়ত ফেসবুকে পোস্ট দেয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীর পিএস হিসেবে পরিচয় দিতো।
আর এই পরিচয় দিয়ে মন্ত্রণালয়ে চাকরি, বদলি, বিভিন্ন অজুহাত ও সমস্যার সমাধানের কথা বলে খোদ সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। হাতিয়ে নেয়া টাকা দিয়ে রাতভর ডিজে পার্টিতে গিয়ে নারী ও মদের নেশায় সময় কাটাতো। দিনে তার ২০ হাজার টাকার মদ লাগতো। অবশ্য হালে রেহাই মেলেনি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুই উপ-পরিচালকের কাছ থেকে এক অতিরিক্ত সচিবের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতারণা করতে গিয়ে তার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে। পরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের একটি টিম ওই প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি তার সহযোগী মো. শাকিল ইসলামকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছে থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৬টি মোবাইল ফোন ও ১২টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রতারক সোহেল ইসলামের বিরুদ্ধে ৪টি প্রতারণা, ৩টি মাদক, ২টি মারামারি, ১টি নারী নির্যাতন ও ১টি বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা রয়েছে। সে কখনো মন্ত্রীর পিএস, কখনো সচিব আবার কখনো অতিরিক্ত সচিবের পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সে নিজের সামাজিক অবস্থান প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে ছবি তুলে রাখতো।সুযোগ বুঝে সেসব ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করতো। তুলে ধরতো তাদের সঙ্গে সখ্যতার কথা। এসব দেখে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ২০১৫ সালে এমপিদের গাড়ির স্টিকার নিজের গাড়িতে লাগিয়ে প্রতারণা করার সময় ধরা পড়েছিল। ওই সময় ধানমণ্ডি থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। তার সহযোগী শাকিলের বিরুদ্ধেও দুটি মাদক মামলা রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বহু বছর ধরে সোহেল ইসলাম রানা মানুষের সঙ্গে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করে আসছে। মন্ত্রীর পিএস, সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের কণ্ঠ হুবহু নকল করে সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলতো। একেক জনের কাছে একেক অজুহাতে কথা বলে টাকা আদায় করতো। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, কর্মকর্তাদের ভালো জায়গায় বদলি, প্রমোশন, বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের কথা বলে টাকা নিয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে যাবতীয় টাকা সে বিকাশের মাধ্যমে নিতো।
তার বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য রয়েছে। ডিবি কর্মকর্তারা জানান, সে এখন পর্যন্ত কত টাকা হাতিয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে তার লেনদেন দেখে মনে হচ্ছে হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ অনেক বড় হবে। কারণ রানা যে স্টাইলে চলাফেরা করতো তাতে তার মাসে খরচ আছে লাখ টাকা। দিনে ২০ হাজার টাকার মদ লাগতো তার। এ ছাড়া নারীদের সঙ্গ পাওয়ার প্রতি ঝোঁক রয়েছে। বহু নারীর সঙ্গে সে রাত কাটিয়েছে। তার নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক নারী তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।এ ছাড়া রানা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে। তার বিরুদ্ধে ৩টি মাদক মামলা রয়েছে। সে একাধারে নিজে মাদক সেবন করতো আবার ব্যবসাও করতো। তার সহযোগীর বিরুদ্ধেও মাদক মামলা রয়েছে।
ডিবির সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সূত্র বলছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের অফিস সহায়ক মোস্তাফিজুর রহমান তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে তিনি বলেন, জামালপুর জেলার উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানা ফোন করে জানিয়েছেন এক ব্যক্তি তার কাছে ফোন করে অতিরিক্ত সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোলের পরিচয় দিয়ে বলে, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের শ্যালিকাকে জামালপুর জেলার ইসলামপুরে বিয়ে দেয়া হয়েছে।
এই মুহূর্তে মন্ত্রীর শ্যালিকার ২৫ হাজার টাকার বিশেষ প্রয়োজন। ওই ব্যক্তি যে নম্বর থেকে ফোন দিয়েছে সেটিতে নগদ অ্যাকাউন্ট খোলা আছে। তিনি যেন ২৫ হাজার টাকা ওই নম্বরে দ্রুত পাঠিয়ে দেন। বিষয়টি জাকিয়া সুলতানার সন্দেহজনক মনে হলে তিনি অতিরিক্ত সচিবকে ফোন দিয়ে বিষয়টি খুলে বলেন। ঘটনা শোনার পর অতিরিক্ত সচিব উপ-পরিচালককে টাকা পাঠাতে নিষেধ করেন। ডিবির সাইবার সূত্র আরো জানায়,একইভাবে ওই অতিরিক্ত সচিবের পরিচয় দিয়ে শেরপুরের উপ-পরিচালক ড. মোহিত কুমার দে এবং ময়মনসিংহের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ড. মো. রেজাউল করিমের কাছ থেকে সোহেল ইসলাম রানা মন্ত্রীর শ্যালিকার বিয়ের কথা বলে নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলে। তাদের কাছেও সন্দেহজনক হওয়াতে বিষয়টি তারা অতিরিক্ত সচিবকে জানান। তারা বুঝতে পারেন কেউ ছদ্মবেশ ধারণ করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার অতিরিক্ত কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের কণ্ঠ হুবহু নকল করে রানা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। এমপি মন্ত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রকাশ করে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সে মিথ্যা ভিআইপি হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এসব পুঁজি করেই মূলত সে প্রতারণা করতো।