দেশের যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি একইসঙ্গে আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তরিকভাবে দেশের সেবা করবেন।
তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেনাবাহিনীর সব সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও পরিপূর্ণ অনুগত থেকে কঠোর অনুশীলন, পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের সেবায় কাজ করে যাবেন।
আজ বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) সকালে সাভার সেনানিবাসে সিএমপি সেন্টার অ্যান্ড স্কুলে সদর দফতর ৭১ মেকানাইজড ব্রিগেড, ১৫ ও ৪০ ইস্ট বেঙ্গল (মেকানাইজড) এবং ৯ ও ১১ বীর (মেকানাইজড)-এর পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় যেকোনও প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকবে।
সম্প্রতি সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় আকস্মিক ভয়াবহ বন্যায় প্রশংসনীয় ভূমিকার পালনের জন্য সেনাপ্রধানসহ এই বাহিনীর সব সদস্যকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘অপারেশন কোভিড শিল্ড’-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সদস্যরা করোনা প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও মর্যাদা, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ
সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবহমানকাল থেকেই যুদ্ধের ময়দানে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক ‘পতাকা’ বহন করার রীতি প্রচলিত আছে। পতাকা হলো জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্মান এবং মর্যাদার প্রতীক। তাই পতাকার মান রক্ষা করা সব সৈনিকের পবিত্র দায়িত্ব।
অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রীকে কুচকাওয়াজের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরি। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি। ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছি। আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। এছাড়া অ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করেছি।
দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। তিনি বলেন, গত চার বছরে বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে তিনটি ব্রিগেড এবং ছোট-বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলছে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্ত করেছি। এছাড়াও অত্যাধুনিক এমবিটি-২০০০ ট্যাংক, অ্যাম্ফিবিয়াস ট্যাংক ভিটি-৫, এমএলআরএস রেজিমেন্ট, মর্টার রেজিমেন্ট, সেল্ফ প্রোপেল্ড রেজিমেন্ট, এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার ও কাসা সি-২৯৫ ডব্লিউর মতো অত্যাধুনিক পরিবহন বিমান, অত্যাধুনিক ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র মেটিস-এম-১, বিমান বিধ্বংসী মিসাইল এফএম-৯০ এবং আধুনিক পদাতিক সৈনিক ব্যবস্থা সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেছি।
সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের পাশাপাশি ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশে একের পর এক সেনাশাসন, হত্যা ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অতীত ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস মুছে যায়। একের পর এক সেনাবাহিনীতে ক্যু হতে থাকে। সামরিক বাহিনীর অফিসার সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লাশ গুম করে দেওয়া হয়। এখনও সেদিন গুম হওয়াদের স্বজনহারারা কেঁদে বেড়াচ্ছে সেই বেদনা নিয়ে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
‘৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে সে সময়কার সেনা শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এক কম জোর করেই প্রবাস জীবন কাটানোয় বাধ্য হওয়া অবস্থা থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন এবং সেনাবাহিনীর এই সদস্যদের হত্যার প্রতিবাদ করেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সশস্ত্র বাহিনীতে আর কোনও ছেলেহারা মায়ের ও স্বজনহারা পিতার কান্না এবং সন্তানের আহাজারি শুনতে চাই না। আর কোনও বিধবা দেখতে চাই না।’
সরকারে আসার পর দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় দেশের আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য চিত্রও তুলে ধরেন তিনি।