গুলিতে নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো-আততায়ী আটক : বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শোক প্রকাশ
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ৬৭ বছর বয়সী জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের উপর এক বন্দুক হামলার ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। নারা শহরের নির্বাচনী প্রচারণা চালানো সময় তাকে গুলি করা হয়। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। জাপানের গণমাধ্যম এনএইচকে জানিয়েছে, ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় তাকে পেছন থেকে গুলি করা হয়। তখন তিনি বক্তৃতার মাঝখানেই লুটিয়ে পড়েন। এরপর তার রক্তক্ষরণ হয়। পুলিশ বলছে ৪১ বছর বয়সী হামলাকারীকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার পর টোকিওর সাবেক মেয়র ওইচি মাসুজো এক টুইট বার্তায় বলেন, মি. আবে বর্তমানে কার্ডিওপালমোনারি অ্যারেস্ট অবস্থায় আছেন। জাপানে কার্ডিওপালমোনারি অ্যারেস্ট বলতে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যু নিশ্চিত করার আগের অবস্থাকে বোঝানো হয়।
বিশ্বমঞ্চে জাপানের প্রভাব আরো শক্ত করা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা শিনজো আবের গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার সংবাদে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ‘ভয়াবহ বাজে খবর। আমরা সবাই শিনজোর জন্য প্রার্থনা করছি’, নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে এমনটাই বলেছেন তিনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনও ‘গভীর দুঃখ’ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। আবের পরিবার ও জাপানের জনগণের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবেকে গুলি করার ঘটনায় ‘পুরোপুরি স্তম্ভিত ও ব্যথিত’ হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আবের ওপর হামলার ঘটনায় ‘গভীরভাবে ব্যথিত’ হওয়ার কথা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রাহম ইমানুয়েল বলেন, শিনজো আবে জাপানের একজন অসাধারণ নেতা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অটল একজন মিত্র ছিলেন। শিনজো আবে, তার পরিবার ও জাপানের জনগণের মঙ্গল কামনা করছে মার্কিন জনগণ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ টুইটে লিখেছেন, জাপান থেকে হতাশাজনক খবর- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে’কে গুলি করা হয়েছে। এ সময়ে তার পরিবার ও জাপানের জনগণের জন্য আমাদের প্রার্থনা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বলেছেন, জি-২০ভুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের তরফে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহানুভূতি জানানো হয়েছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন বলেন, আমার মনে হয় এ খবরে আমার মতো সবাই বিস্মিত ও বেদনাহত হয়েছেন। তাইওয়ান ও জাপান উভয়েই আইনের শাসন দিয়ে পরিচালিত দুটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমার সরকারের পক্ষে ভয়াবহ সহিংসতা ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শুধু আমারই একজন ভাল বন্ধু নন, একই সঙ্গে তাইওয়ানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাইওয়ানকে তিনি বহু বছর ধরে সমর্থন দিয়ে আসছেন।
শিনজো আবে জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। মি. আবেকে দুইবার গুলি করা হয় এবং দ্বিতীয় গুলিটি তার পিঠে আঘাত করে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জাপানের এনইচকে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, হাসপাতালে নেবার পর থেকে মি. আবের কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। নির্বাচনী সমাবেশটিতে উপস্থিত ছিলেন এনএইচকের সাংবাদিক। ঘটনাস্থল থেকে তিনি জানান, বেলা ১১টার দিকে শিনজো আবে যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন তিনি দুটি গুলির শব্দ শুনতে পান। জাপান পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষের নির্বাচনে একজন প্রার্থির সমর্থনে প্রচারণা চালানোর জন্য মি.আবে নারা শহরে গিয়েছিলেন। মি. আবে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে তার বড় প্রভাব রয়েছে। এ দলের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ মি. আবের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিনজো আবে ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।
২০০৬ সালে তিনি প্রথবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১২ সালে তিনি আবারো প্রধানমন্ত্রী হন। মি. আবে ধনাঢ্য রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। তার বাবা ছিলেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া তার এক দাদা জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জাপানে বন্দুক হামলা খুবই বিরল ঘটনা। কারণ, সেখানে অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ। এছাড়া জাপানে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের টার্গেট করে হত্যা করার ঘটনাও খুব একটা দেখা যায় না। ২০০৭ সালে নাগাসাকি শহরের মেয়র ইচো ইতোকে গুলি করে হত্যা করেছিল গ্যাংস্টাররা। ১৯৬০ সালে জাপানের সোশালিস্ট পার্টির প্রধানকে বক্তব্য দেবার সময় গুলি করে হত্যা করে ডানপন্থীরা।
জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলা চালানো ব্যক্তিকে সঙ্গে সঙ্গেই আটক করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, হামলাকারীর নাম তেতসুয়া ইয়ামাগামি। তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। ৪১ বছর বয়সী তেতসুয়া জাপানের সামুদ্রিক আত্মরক্ষা বাহিনীর সাবেক সদস্য বলে শোনা যায়। হামলার আগে শিনজো আবের ১০ ফুট পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আবে বক্তব্য রাখার মধ্যে তার ওপর দুবার গুলি চালান তেতসুয়া। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ওপর পড়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে তার রক্তাক্ত শরীর দেখা গেছে। গুলি চালানোর পর ঘটনাস্থল থেকে পালানোর কোনো চেষ্টাই করেননি হামলাকারী।
তাকে সঙ্গে সঙ্গে আটক করেন নিরাপত্তাকর্মীরা। তেতসুয়াকে এখন নারা নিশি পুলিশ স্টেশনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হামলাকারী পুলিশকে জানিয়েছেন, হত্যার উদ্দেশ্যেই তিনি আবের ওপর গুলি চালিয়েছেন। দাবি, তিনি শিনজো আবের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তবে তার কারণ কী তা এখনো জানা যায়নি। খবরে বলা হয়েছে, তেতসুনা শিনজো আবেকে গুলি করার জন্য একটি শটগান ব্যবহার করেছেন। সেটিও তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেতসুনার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রেসিডেন্টের শোক : প্রেসিডেন্ট এম আবদুল হামিদ গতকাল জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় প্রেসিডেন্ট হামিদ জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপ্রধান শোকবার্তায় শিনজোর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। সূত্র : এনএইচকে, এনডিটিভি, বাসস।