প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে উদ্বোধন হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এতে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার ভোগান্তি নিরসনের পাশাপাশি বাঁচবে সময়। লঞ্চ-ফেরিতে আগে যেখানে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগতো, এখন সহজেই ৬-৭ মিনিটে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলে যাওয়া যাবে নদীর এপার থেকে ওপার। বহুল প্রতীক্ষিত সেতু উদ্বোধনে তাই দক্ষিণবঙ্গবাসীর উচ্ছ্বাস সবচেয়ে বেশি।
এতদিন শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাঝিকান্দি নৌরুটে লঞ্চ, স্পিডবোট আর ফেরিতে করে নদী পারাপার হলেও এখন সেতু হয়ে দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকা আর ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গ যাতায়াত করা যাবে।
ঘাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ নৌরুটে লঞ্চে পারাপারে ৫০ মিনিট থেকে একঘণ্টা সময় নেয়। ফেরিতে যানবাহন পারাপারে সময় লাগে দেড়ঘণ্টার কিছুটা বেশি। নদীর স্রোতের ওপর নির্ভর করে সময় কমবেশি হয়।
বরিশালের মাসুম মোল্লা নাগরিক খবরকে বলেন, ‘ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। নদী পার হতে এক থেকে দেড়ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তবে জরুরি সময়ে আমাদের বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সময়মতো ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করাতে না পেরে আমার দুই নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আর সেই দুর্ভোগ থাকবে না। কাউকে আর মরতেও হবে না।’
মাদারীপুরের বাসিন্দা টিএম আজিম বলেন, ‘আমাদের কষ্টের দিন ফুরাইলো। আগে ঢাকায় পৌঁছাতে এক থেকে দেড়ঘণ্টা লাগতো। তার ওপর ঝড়-বৃষ্টি হলে ফেরিঘাটে ফেরি বন্ধ হয়ে যেতো। কুয়াশায়ও ফেরি চলাচল বন্ধ থাকতো। এখন দেড় দুই ঘণ্টার পথ গাড়িতে করে ৬-৭ মিনিটে পার হয়ে যেতে পারবো। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় স্বস্তি।’
শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকার সোহেল মিয়া বলেন, শিশু বাচ্চাসহ পরিবার নিয়ে পারাপার হতে হয়। নদীতে ঢেউ থাকলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এখন আর কোনো আশঙ্কা-চিন্তা থাকলো না।
ঘাটে দেখা হয় মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকার বাসিন্দা ও ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াজ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঈদ কিংবা উৎসব এলে বন্ধুদের দেখেছি খুব কষ্টে নদী পার হতে। এমনও হয়েছে শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় পরীক্ষা দিতে আসবে কিন্তু সময়মতো আসতে পারেনি। পরীক্ষাও দিতে পারেনি।’
শিমুলিয়াঘাটের ফল ব্যবসায়ী সফিকুল বলেন, সবচেয়ে ভালো হলো মুমূর্ষু রোগীদের জন্য। তাদের সময়ের সঙ্গে জীবনের কাটাও ঘুরতে থাকে। জীবন-মরণ মুহূর্তে সময়ের দাম সবচেয়ে বেশি। এখন তারা সহজেই নদী পার হতে পারবেন। মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যাবে।
স্বপ্ন, সক্ষমতা আর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে শনিবার (২৫ জুন)। দুপুর ১২টার দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার (২৬ জুন) ভোর ৬টায় যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেওয়া হবে।
২০০১ সালের ৪ জুলাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এ সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে।
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।
পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার স্বপ্নের অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।