বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের আইনটি কার্যকর না থাকার ফলে সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে আমাদের দেশে বিশেষ করে শহর এলাকায় বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার দ্বন্দ্ব এখন এমন প্রকট আকার ধারণ করছে যে ক্ষেত্রবিশেষে তা চুরি, ডাকাতি এমনকি নারী নির্যাতনের মামলায় গিয়েও ঠেকছে। আইনটি না মানার প্রবণতা বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া উভয়ের মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে
বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, তারা কথায় কথায় ভাড়া বাড়িয়ে দেন, বিনা নোটিশে বাসা ছাড়তে বলেন, বাড়িতে থাকতে হলে ‘অযৌক্তিক’ শর্ত আরোপ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগগুলো সত্য। অন্যদিকে, ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে বাড়ির মালিকদের অভিযোগ, তারা নিয়ম মানতে চান না, বাসার ক্ষতি করেন।
এসবের পাশাপাশি বাড়িওয়ালাদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হচ্ছে রাজধানীসহ সারাদেশে এখন একটা চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে যারা ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠে জাল দলিল তৈরির মাধ্যমে ফ্ল্যাট-বাড়ির দখল নিয়ে নেয়। চক্রের কেউ কেউ আবার আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর ভাড়া পরিশোধ করেন না।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বলছে, এ আইনে পেশ করা দরখাস্তের শুনানি তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে কোন দরখাস্তের শুনানি করা সম্ভব না হলে নিয়ন্ত্রক কারণ লিপিবদ্ধ করে যথাশিগগির সম্ভব শুনানির ব্যবস্থা করবেন। তবে ইতিহাস বলছে, যত দরখাস্ত পেশ করা হয় এর প্রায় প্রতিটিই বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে।
গত বছর প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে ঢাকার সাভারে ফ্ল্যাট দখল ও মালিককে মারধরের অভিযোগ ওঠে সাইদুর রহমান ওরফে শেখ সাইদ নামে এক ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে ও ফ্ল্যাট উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে সংবাদ সম্মেলন করেন ফ্ল্যাটমালিক মনিরুল। ঘটনাসূত্রে জানা যায়, ভাড়াটিয়া মামুন তার মামা সাইদুরের সহযোগিতায় জাল দলিল তৈরি করে ফ্ল্যাট দখল করে। এ নিয়ে সাভার মডেল থানায় মামলাও হয়েছিল।
রাজধানীতে বাড়িভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য নতুন নয়। আবাসনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ দিন দিন বাড়ছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক বাড়ির মালিক যেমন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের মর্জিমাফিক বাড়িভাড়া বাড়িয়েছেন, করোনাকালে ভাড়াটিয়াদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করেছেন তেমনই মুদ্রার অন্য পিঠে সাইদুর, মামুনদের মতো চক্রটিও বাড়িওয়ালাদের আতঙ্ক হয়ে উঠছে।
একদিকে বাড়িভাড়া আইনের অসম্পূর্ণতা, অন্যদিকে আইনে যতটুকু বিধান উল্লেখ আছে তারও প্রয়োগ নেই। ফলে ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিকদের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। সীমাহীন ভোগান্তিতে থাকা অতিষ্ঠ অধিকারবঞ্চিত এসব মানুষ কোথায় আশ্রয় পাবেন, কার কাছে কষ্টের কথা জানাবেন তা কেউ জানেন না। বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে, গত ২৫ বছরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ ভাগ। কিন্তু রাজধানীতে বাসাভাড়া বেড়েছে ৪০০ ভাগ বেশি। করোনাকালে ক্রমবর্ধমান এই ভাড়া মিটিয়ে ঢাকায় টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে- ১৯৯১ সালে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হলেও ২০০৭ সালের জুলাই মাসে এসে ঢাকা মহানগরীকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। কিন্তু এসব আইনের বিধান কখনও কার্যকর হয়নি। কোন এলাকার ভাড়া কতো হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে সরকার কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি। এর পাশাপাশি আইনটির বেশকিছু ধারা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে আইনটির ১৮ ধারার একটি উপ-ধারা প্রণিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে, ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়িভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত ওই ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। কিন্তু শর্ত হলো, ভাড়াটিয়া এমন আচরণের জন্য দোষী, যা সংলগ্ন বা পার্শ্ববর্তী বাড়ির দখলকারীদের কাছে উৎপাত বা বিরক্তিস্বরূপ, সে ক্ষেত্রে আগের রক্ষাকবচ প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, কেউ কেউ বছরের পর বছর ভাড়া পরিশোধ না করেও কিংবা জাল দলিল তৈরি করে ফ্ল্যাট-বাড়ি দখল করে রাখলেও, আইনটি এইক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ভাড়াটিয়া তার শর্তসমূহ পালন না করে কিংবা জাল-জালিয়াতি করলেও রক্ষাকবচ তার জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে।
কদা