১৯ জনের যাবজ্জীবন ২৫ জন খালাস
সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা মামলায় ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন আদালত। একই সঙ্গে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৫ জনকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন। মামলা চলাকালীন মারা যাওয়ায় তিন আসামিকে আগেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ১৩ জনের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সাজা দেয়া হয়। আর যাবজ্জীবনপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শব-ই-বরাতের রাতে ৬ ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এদিকে কোর্ট রিপোর্টার জানিয়েছেন ,রায়কে কেন্দ্র করে আদালত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষ ও নিহত ছাত্রদের পরিবার রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছেন,পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে পর্যালোচনা শেষে খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপীলে যেতে পারি। এদিকে ভুক্তভোগীর পরিবার এই রায় যেন উচ্চ আদালতে বহাল থাকে সেই প্রত্যাশা করেন। আসামি পক্ষে আইনজীবী ও পরিবার রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা ন্যায়বিচার পাননি বলে অভিযোগ করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
আদালত যাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন তারা হলেন আব্দুল আলিম, সাইদ মেম্বার, আব্দুর রশিদ, ইসমাইল হোসেন, জমসের আলী, মির হোসেন, মজিবর রহমান, নুর হোসেন, রজ্জব আলী, আলম, রানা, আব্দুল হামিদ, আসলাম মিয়া। যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলেন শাহীন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজিব হোসেন, ওয়াসিম, সাত্তার, সেলিম, মনির হোসেন, আলমগীর, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বশির, রুবেল, নূর ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন, টুটুল, মাসুদ, মোখলেস, তোতন, সাইফুল। বিচার চলাকালে মৃত তিন জন কবির হোসেন ,রাশেদ ও সাব্বির আহম্মেদকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মোট ৫৭ জন আসামির মধ্যে ৩২ জনকে কারাদণ্ড দিল আদালত। বাকি আসামি খালাস পেয়েছে। এর আগে, গত ২২ নবেম্বর আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুনানি শেষে আদালত রায় ঘোষণার জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন আাদালত।
আদালতের বিচারক ইসমত জাহান এই রায় ঘোষণা করেন। বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে রায় পড়া শুরু করে ১১টা ৫০ মিনিটে শেষ হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের আত্মীয় স্বজন ও নিহত ছাত্রদের আত্মীয় স্বজন উপস্থিত ছিলেন।
সাভারের আমিনবাজারে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শব-ই- বরাতের রাতে ৬ ছাত্র হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আদালত পাড়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাদের আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনন্দ চন্দ্র বিশ্বাস রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন , এই আলোচিত হত্যা মামলাটির রায় দীর্ঘদিন পর ঘোষণা হলো। রায়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেছিলাম আসামিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। রায়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট। তিনি আরও বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় বের হলে আদেশ পর্যালোচনা শেষে খালাস আসামিদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীলে যেতে পারি। একটা চাঞ্চল্যকর মামলায় যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন আদালত।
নিহত কামরুজ্জামানের বাবা আব্দুল কাদের মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মামলাটির রায়ে আমি সন্তুষ্ট, দীর্ঘদিন পরে হলেও রায় হয়েছে। রায়ে প্রকৃত দোষী আসামিদের শাস্তি হবে এই প্রত্যাশা ছিল আমাদের। আজকের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। টিপু সুলতানের মা কাজী নাজমা সুলতানা বলেন, সব আসামির ফাঁসি আশা করেছিলাম। তাহলে আরও খুশি হতাম। তবে এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এতদিন কষ্ট পেয়েছি। যতদিন বেঁচে থাকব কষ্ট পাব। তারপরও যে সাজা পেয়েছে তাতে শুকরিয়া আদায় করি। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েনি তিনি। পলাশের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, ন্যায়বিচার পেয়েছি। তবে রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়।ইব্রাহিম খলিলের বাবা আবু তাহের বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। দোষীদের সাজা হয়েছে। তবে আশা, রায়টা যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়।
আসামি পক্ষ এ রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবেন বলে জানিয়েছেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী শিউলী আক্তার খান ও শেখ সিরাজ উদ্দিন বলেন, আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব। রায়ে ন্যায়বিচার হয়নি। এই মামলায় কোন চাক্ষুষ সাক্ষী নেই। এই সাজা উচ্চ আদালতে টিকবে না। মামলার তদন্ত ঠিকমতো সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি টোটালি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। উচ্চ আদালতে গেলে আসামিরা খালাস পাবেন বলে আশা করেন আইনজীবীরা।
কি ঘটেছিল সে দিন ॥ ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শব- ই-বরাতের রাতে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলাচরে ঘুরতে যান ৭ বন্ধু। ডাকাত সন্দেহে তাদের মধ্যে ছয় জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত ছাত্ররা হলেন ধানম-ি ম্যাপল লিফের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম, মিরপুর সরকারী বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণীর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত।
হামলায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান কেবল আল-আমিন। পরে তার কাছ থেকে সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। ওই হত্যাকা-ের পর সাভার থানা পুলিশ একটি মামলা করে, যাতে অজ্ঞাতপরিচয় গ্রামবাসীদের আসামি করেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন।
অন্যদিকে ডাকাতির অভিযোগ এনে আল-আমিন এবং তার নিহত ছয় বন্ধুর নামে একটি মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী মালেক। পরে আলোচিত ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তে বেরিয়ে আসে, নিহত ছাত্ররা ডাকাত ছিল না এবং হত্যা এড়াতে পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি।
ছয় ছাত্রকে হত্যা মামলার তদন্তভার থানা পুলিশের হাত থেকে সিআইডি এবং পরে আদালতের নির্দেশে র্যাবের হাতে যায়। র্যাবের সহকারী পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি সেই মালেকসহ ৬০ জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ওই বছর ৮ জুলাই ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ মোঃ হেলালউদ্দিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভিকটিম আল-আমিনকে ডাকাতির মামলা থেকে সেদিনই অব্যাহতি দেয়া হয়। তদন্ত চলাকালে আসামিদের ১৪ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিলেন। আর মামলার বিচারকালে রাষ্ট্রপক্ষে ৫৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয় বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাকিলা জিয়াসমিন মিতু