কোনো পুলিশ সদস্য একটা ঘটনা ঘটালে তার দায় কেন ২ লাখ ২০ হাজার সদস্যের সমগ্র পুলিশ বাহিনী নেবে? কোনো পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নেবে না—দীর্ঘদিন ধরে এই নীতিতে অটল রয়েছে পুলিশ বাহিনী। কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে সে অপরাধী বলে গণ্য হবে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার পর সেনাবাহিনীর প্রধান ও বাংলাদেশ পুলিশপ্রধানের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, এ ঘটনায় ব্যক্তি জড়িত, কোনো বাহিনী নয়। তার পরও সমগ্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন মহল বিদ্বেষমূলক আচরণ করছে। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যাহত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, গঠনমূলক কথা না বলে এভাবে ঢালাওভাবে সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে দোষারোপ করা হলে পুলিশ সদস্যরা কাজের প্রতি উত্সাহ হারিয়ে ফেলবেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার মন্ত্রে সবার একমত হওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের প্রতি মানুষের এত বিদ্বেষ কেন? যারা বিদ্বেষমূলক আচরণ করছে, তারা প্রকৃতপক্ষে বহির্বিশ্বের দালাল। বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। মনে রাখতে হবে, করোনার সময়ে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করছে দেশের পুলিশ বাহিনী। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিরাপত্তার বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের পাশে থেকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন এ বাহিনীর সদস্যরা। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার ও প্রতিবেশীর সুরক্ষায় কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, এমনকি মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনও করছে পুলিশ। দরিদ্র ও অসহায় মধ্যবিত্তের ঘরে খাবারও পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। মানবিকতার হাত বাড়িয়ে এ ধরনের কাজ করায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দেশের মানুষের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। করোনা পরিস্থিতিতে সবাইকে যখন বেশি করে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, সেই সময় মানুষকে সেবা দিতে রাস্তায় নেমে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় অর্ধশত। শুধু করোনাকাল নয়, জঙ্গিবাদ দমন, সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অবদান রয়েছে পুলিশ বাহিনীর। জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বর চালুর পর থেকেই সারা দেশের মানুষ উপকার পাচ্ছে। দেশের যে কোনো নাগরিক ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা পুলিশের সেবা পান। তবে এমন বড় বাহিনীতে গুটি কয়েক বিচ্ছিন্ন ঘটনায় বিদ্বেষ বাড়ছে পুলিশ বাহিনীর প্রতি। তার পরও পুলিশের প্রতি কেন এত বিদ্বেষ—এমন প্রশ্ন রেখে বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, এদেশে ব্যাংক লুট হয়েছে, শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের ঘুষের বাণিজ্য অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কিন্তু কারোর কিছু হয় না। আর পুলিশ সদস্যরা একটু কিছু করলে বিভিন্ন মহল উত্তেজিত হয়ে যায়। মিডিয়াও বুঝে কিংবা না বুঝে ফলাও করে প্রচার করে। পুলিশ জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি। তাই পুলিশের কাজ সবাই দেখতে পায়। সচিবালয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি কেউ দেখে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে এমন অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ১৮৬১ সালে ব্রিটিশদের স্বার্থে পুলিশ ফোর্স গঠন করা হয়। তখন থেকে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করলেও জনগণের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তন করা হয়নি। এখনো পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের ফোর্স হিসেবে কাজ করে। জনগণ ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব আরো কমিয়ে আনতে হবে। অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর পুলিশি কার্যক্রম ও গণতন্ত্রায়ণের সময়কার পুলিশি কাঠামো এক রয়ে গেছে। এ ধরনের প্রবণতা পরিবর্তন করা উচিত। মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কোনো না কোনোভাবে পুলিশ জড়িত। পুলিশ খারাপ হলে যেমন ভুক্তভোগী হবে নাগরিকগণ, তেমনি পুলিশ ভালো হলে সুবিধাভোগীও হবে সম্মানিত নাগরিকগণই। সুতরাং দেশ, মাটি আর মানুষের কল্যাণেই পুলিশের ইতিবাচক পরিবর্তন করাটাই জরুরি।
মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামাল আহমেদ বলেন, মানুষ যখন মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখনই এসব অনাস্থা তৈরি হয়। পুলিশের প্রতিও হয়তো এমন অনাস্থা রয়েছে, যার কারণে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় পুলিশকে। তিনি বলেন, মানুষ যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গিয়ে প্রতিকার পায় না, যে ধরনের ডিসিপ্লিন মানুষ প্রত্যাশা করে তা যখন না পায়, তখন পুলিশের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, পুলিশের ওপরও নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের চাপ আসে। সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, প্রশাসনিক হতে পারে, কখনো অর্থনৈতিক সামর্থ্যও পুলিশকে দেওয়া হয় না। এসব পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সামলে পুলিশ বাহিনী নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করে চলতে পারে না।