কুমিল্লা চান্দিনা উপজেলার গল্লাই ইউপির বসন্তপুর গ্রামে পুকুরে ভাসমান কিশোরী সালমার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় মূল ঘটনা বেরিয়ে আসল পিতা তার নিজের মেয়েকে হত্যা করল প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে। ঘটনাটি কম বেশি সবার বিবেকে নাড়া দিয়েছে। পিতার নিষ্ঠুরতায় ব্যথিত হল দেশ ও সমাজের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। সম্পত্তির লোভ এবং নিজের ভাতিজা প্রতিপক্ষ শাহজালাল ও শাহ কামালের উপর প্রতিশোধ নিতে এত বড় নিষ্ঠুর ও জগণ্য ঘটনা কখনও কাম্য নয়। ধিক্কার রইল এই কুলাঙ্গারদের প্রতি। চান্দিনা থানা পুলিশ ও দাউদকান্দি-চান্দিনা সার্কেলের সিনিয়র এএসপি জুবায়ের জুয়েল রানার নিরলস পরিশ্রমে সালমা হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন করা হয়। সবাই জানতে পারল প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই নিজের মেয়েকে হত্যা করে পাষন্ড পিতা সোলায়মান।
কিশোরী সালমা হত্যার নিষ্ঠুরতা : কুমিল্লা জেলা পুলিশের প্রেস বিফ্রিং-
চান্দিনা থানার ১০নং গল্লাই ইউনিয়নের বসন্তপুর ভূইয়া পাড়া গ্রামের মোঃ সোলেমান(৪৫) ও তাহার ভাতিজা শাহজালাল(২৬) ও শাহ কামাল(২৩) এর সাথে জায়গা জমি নিয়ে দীর্ঘ দিনের বিরোধ ও মামলা মোকদ্দমা চলে আসছিল। স্থানীয় ভাবে বিরোধীয় বিষয়টি মিমাংসার জন্য একাধিকবার শালিস-বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত-২৫/০৯/২০২১খ্রিঃ তারিখ পূর্বের জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একে অপরকে গালিগালাজ করে।
এক পর্যায়ে শাহজালাল ও শাহ কামাল গং মোঃ সোলেমানের স্ত্রী হালিমা বেগম(৩৮) এবং বড় মেয়ে এলমা(১৭) কে মারপিট করে আহত করে এবং তাদের ০১টি মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে যায় মর্মে চান্দিনা থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়। মামলাটি তদন্তাধীন অবস্থায় গত-০২/১০/২০২১খ্রিঃ তারিখ সকাল ০৬.৩০ ঘটিকার সময় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চান্দিনা থানার অফিসার ইনচার্জ সংবাদ পান যে, চান্দিনা থানাধীন ১০নং গল্লাই ইউনিয়নের বসন্তপুর ভূঁইয়া পাড়া এলাকায় পুকুরের মধ্যে সালমা আক্তার(১৪) নামের একটি মেয়ের লাশ ভেসে আছে। উক্ত সংবাদের প্রেক্ষিতে চান্দিনা থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পুকুর হতে লাশ উত্তোলন করে এবং জানতে পারে উক্ত লাশটি সালমা আক্তার(১৪), পিতা-মোঃ সোলাইমান, গ্রাম-বসন্তপুর(ভূঁইয়া পাড়া), ডাকঘর-গল্লাই, থানা-চান্দিনা, জেলা-কুমিল্লার।
চান্দিনা থানা পুলিশ লাশের গলায়, কাঁধে, পেটে, পায়ে ধারালো অস্ত্র দ্বারা গুরুতর আঘাত দেখতে পায়। লাশের সুরাতহাল প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরন করেন। এ সংক্রান্তে ভিকটিম সালমা আক্তারের বাবা বাদী হয়ে তার ভাতিজা ১। মোঃ শাহজালাল(২৬), ২। মোঃ শাহ কামাল(২৩) সহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২/৩জনের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করলে চান্দিনা থানার হত্যা মামলা নং-০১, তাং-০২/১০/২০২১খ্রিঃ, ধারা-৩০২/৩৪ পেনাল কোড রুজু করে মামলার তদন্তভার এসআই(নিঃ)/সুজন দত্ত এর উপর অর্পন করা হয়।
বাদির এজাহারে দায়েরকেরা বক্তব্য ও হত্যাকন্ডের ধরণ ও পারিপার্শিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সন্দেহ হয় যে, ঘটনার পিছনে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে।
আমরা এই বর্বোরচিত হত্যার রহস্য উদঘাটনে দিন-রাত্র পরিশ্রম করে ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় বাদীর এজাহারের বক্তব্যের সাথে তথ্যের গরমিল থাকায় ঘটনার দিন বাদী, স্বাক্ষী ও আসামীদের ঘটনার সময় ও আগে-পরে তাহাদের অবস্থান এবং কার কি ভূমিকা ছিল এই নিয়ে ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করি। বাদী সোলেমান হত্যা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছিল, ঘটনার সময় সে তার উকিল শ্বশুর আব্দুর রহমান এর বাড়ীতে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির সহায়দায় দেখা যায় ঘটনার সময় তারা সবাই সোলেমানের বাড়ীর আশপাশে অবস্থান করছিল এবং তারা না ঘুমিয়ে একে-অপরের সাথে সারারাত মোবাইল ফোনে কথা বলেছিল।
তদন্তকালে বাদীর বর্ণিত স্বাক্ষীদের কথাবার্তা ও ঘটনার রাত্রে তাদের অবস্থান সর্ম্পকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রদান ও তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনায় গড়মিল পরিলক্ষিত হওয়ায় বাদী মোঃ সোলেমানের উকিল শ্বশুর প্রতিবেশী আঃ রহমান ও বাদীর বন্ধু মোঃ খলিলকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে উক্ত হত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে এবং তারা জানান যে, প্রতিপক্ষ শাহজালাল গং তাদের বিরুদ্ধে মামলা সৃজন করে তাদেরকে হয়রানি করার জন্য বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাপ করছে জেনে তাদেরকে ভাল ভাবে ফাঁসানোর জন্য সোলেমানের উকিল শ্বশুর আব্দুর রহমান এর বাড়ীতে সোলেমান, আব্দুর রহমান, খলিল সহ ০৭জন মিলে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার প্রাথমিক অবস্থায় সোলেমান নিজের মাথা কেটে শাহজালাল গংদের বিরুদ্ধে পেনাল কোড ৩০৭/৩২৬ ধারার মিথ্যা মামলা সৃজন করার চিন্তুা করে। তবে এতে প্রতিপক্ষ খালাস পেয়ে যেতে পারে। এজন্য পরবর্তীতে প্রতিপক্ষকে আরো কঠিন ভাবে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর জন্য সবাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, সোলেমানের মেয়ে ভিকটিম সালমা আক্তারকে হত্যা করবে এবং হত্যার দায় শাহজালাল গংদের উপর চাপিয়ে দেবে, এতে শত্রুতাও সাধিত হবে এবং বিরোধীয় জায়গা তাদের দখলে চলে আসবে।
সোলেমান জানত যে, তার স্ত্রী হালিমা বেগম এবং বড় মেয়ে এলমা আক্তার বাড়ীতে থাকেলে তাদের এই ঘৃন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবেনা। সেজন্য সোলেমান তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হীন উদ্দেশ্যে স্ত্রী হালিমা বেগম এবং বড় মেয়ে এলমা আক্তারকে নিজ বাড়ীতে না রেখে তার শ্বশুর বাড়ীতে রেখে আসে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রামের সকল লোকজন যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন ০১/১০/২০২১খ্রিঃ তারিখ দিবাগত রাত অথার্ৎ ০২/১০/২০২১খ্রিঃ তারিখ রাত অনুমান ০২.০০ ঘটিকা হতে ০৪.০০ ঘটিকার মধ্যে সোলেমান আব্দুর রহমান, খলিল সহ কয়েকজন আব্দুর রহমান এর বাড়ী হতে সোলেমান এর ঘরে গিয়ে ঘরের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা সোলেমানের ছোট মেয়ে ভিকটিম সালমা আক্তার(১৪)কে কাপড় দিয়ে নাকে-মুখে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা নিশ্চিত করে। এরপর সালমার মৃত দেহ ঘর হতে বাহির করে পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। মানুষজন যাতে তাদেরকে কোন ভাবেই সন্দেহ না করতে পারে সেজন্য ভিকটিম সালমা আক্তারকে ধারালো দা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে নৃশংসভাবে কুপিয়ে কাটা রক্তাক্ত জখম করে লাশ পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেয়।
তদন্তকালে আমরা ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনে যখন অনেক দূর এগিয়ে যাই তখন বাদী সোলেমান ও তার সহযোগীরা আঁচ করতে পারে যে, পুলিশ যেকোন সময় হত্যার রহস্য উদঘাটন করে ফেলবে এবং তারা যে হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে জড়িত সেটাও প্রকাশ হয়ে যাবে। পুলিশ তদন্তের স্বার্থে বাদী সোলেমানের উকিল শশুর আব্দুর রহমান ও বাদীর বন্ধু খলিলকে থানায় ডেকে আনলে সোলেমান ও তার অন্য সহযোগীরা বাড়ী হতে পালিয়ে যায়।
গ্রামের মেম্বার ইসমাইল সহ অন্যান্য লোকজন তাদের সারারাত খোজাখুজি করেও পায়নি। ভোরবেলা ফজরের নামাজের পর পার্শবর্তী বাগুরাপাড়া গ্রামের পুকর পাড়ে খরের গাদার পাশে বাদী সোলেমানকে আহত অবস্থায় লোকজন দেখে হাসপাতালে প্রেরন করেন। সোলেমানের আহত হওয়ার বিষয়টিও রহস্যজনক।
সালমা আক্তারকে হত্যার বিষয়ে আব্দুর রহমান ও খলিল নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য প্রকাশ করলে হত্যা মামলায় তদন্তেপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে তাদেরকে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরন করা হলে তারা হত্যাকান্ডের রাতের সমস্ত ঘটনা বর্ননা করে কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।