কঠোর বিধিনিষেধের পঞ্চম দিন চলমান কঠোর বিধিনিষেধের সময়সীমা যতই কমে আসছে-ততই বাড়ছে যান ও মানুষ চলাচল। বিধিনিষেধের পঞ্চম দিন মঙ্গলবার রাজধানীর সড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ লক্ষ্য করা গেছে। অফিসগামীরা ভাড়া ভাগাভাগি করে রিক্সায় চড়ছেন। পাড়ামহল্লার দোকানপাটগুলোও খুলতে দেখা গেছে বেশি। পাশাপাশি সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের তল্লাশিও চলে। বিভিন্ন সিগন্যালে গাড়িগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শংকর, ধানমÐি লেক, ঝিগাতলা, সিটি কলেজ মোড়, রাসেল স্কয়ার মোড়, গণভবন চেকপোস্ট ও সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে থাকা শেরেবাংলা নগর থানার চেকপোস্ট ঘুরে দেখা যায়, জীবিকার তাগিদে অনেকেই মহল্লায় ছোট দোকানগুলো খুলেছেন।
</
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও শংকর বাসস্ট্যান্ডে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকদের যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে।ধানমÐি লেকে শতাধিক মানুষকে শরীর চর্চা করতে দেখা গেছে। দুপুরের খাবার হাতে অনেককে হেঁটে কাজে যেতে দেখা যায়। এদিকে সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ রয়েছে। সঙ্গে চলছে রিক্সা, মোটরসাইকেল, অফিস বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক। ট্রাফিক পুলিশের ব্যাপক তল্লাশির ফলে চেকপোস্টগুলোয় গাড়ির জটলা সৃষ্টি হয়েছে। তবুও পুলিশ প্রতিটি গাড়ির যাত্রীদের তল্লাশি করছে। যারা অযথা বাইরে বের হয়েছেন বা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। চলমান কঠোর বিধিনিষেধে সরকারী-বেসরকারী অফিস বন্ধ থাকার কথা থাকলেও কিছু কিছু অফিস খোলা রয়েছে। খোলা রয়েছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ফলে গত রবিবার থেকে সড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীতে বৃষ্টি শুরু হলে পথচারীদের বিভিন্ন দোকানের শেডের নিচে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।একান্ত জরুরী প্রয়োজন যাদের, তাদের বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পর্দা টেনে রিক্সায় চড়তে দেখা গেছে। বৃষ্টিতে কিছু সময়ের জন্য ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল চেকপোস্টগুলো। বৃষ্টি কমার পরে আবারও শুরু হয় পুলিশের তল্লাশি।
সড়কে কারা চলাচল করতে পারছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদপুর ট্রাফিক জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জহুরুল হক বলেন, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক অফিস খোলা। আমরা প্রত্যেকটি গাড়িকে জিজ্ঞাসবাদ করছি। ফলে পেছনে গাড়ির দীর্ঘ সিরিয়ালও হয়েছে। এখানে অনেকেই আর্থিক কাজে যাচ্ছেন, রোগী দেখতে যাচ্ছেন, টিকা নিতে যাচ্ছেন, বিভিন্ন পণ্যবাহী গাড়ি আসছে। আমরা চেষ্টা করছি অন্তত কেউ যেন অযথা ঘর থেকে বের না হয়। যাদের কথায় সন্তুষ্ট হচ্ছি না বা কারণ যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।এদিন সকালে যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মানুষের চলাচল ছিল আগের যে কোন দিনের তুলনায় বেশি। এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, প্রাইভেটকার, পণ্যবাহী যানবাহন ছাড়াও রিক্সা, ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা ও ইজিবাইক চলাচল করছে। এছাড়া এ মহাসড়কে ভ্যানে করে মানুষের চলাচলও অনেক বেড়েছে। ভ্যানে মানুষকে গাদাগাদি করে চলাচল করতে দেখা গেছে। যাত্রীরা জানান, জরুরী প্রয়োজনেই তারা বাইরে বেরিয়েছেন। কিন্তু রাস্তায় কোন গণপরিবহন নেই। তাই গন্তব্যে যেতে নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ভ্যানে গাদাগাদি করে উঠতে হচ্ছে।
ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা এভাবে ভ্যানে যাতায়াত প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মানুষের অনুনয়-অনুরোধের কারণে অনেক ক্ষেত্রে খুব একটা সফল হচ্ছেন না তারা। রায়েরবাগে দেখা যায়, একটি ভ্যানে আটজন উঠেছেন। যাত্রীদের কারও কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ আবার কারও হাতে ফাইলপত্র। তারা সাইনবোর্ড এলাকা থেকে শনিরআখড়া যাচ্ছেন।রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ডে ডেমরা জোনের ট্রাফিক সার্জেন্ট সুলতানুল আরেফিন ভ্যানটি থামিয়ে দেন। সার্জেন্ট বলেন, এত মানুষ একসঙ্গে যাওয়া যাবে না। সবাই নামেন। আপনারা কী কেউ কাউকে চেনেন। এরমধ্যে একজন যদি করোনা আক্রান্ত হন তাহলে তো সবাই আক্রান্ত হবেন। সেখানে যাত্রী শামীম হোসেন বলেন, আমার ভাইয়ের পরশু ফ্লাইট, তাই তাকে টিকা দিতে নিয়ে যাচ্ছি। যাওয়ার তো কোন উপায় নেই। বাধ্য হয়ে ভ্যানে গাদাগাদি করে যাচ্ছি।এখানে আরেক যাত্রী ফরিদ হোসেন বলেন, আমি আসছি মদনপুর থেকে। হাঁটছি মাঝে আবার গাড়িতে উঠে সাইনবোর্ড পর্যন্ত আসছি। সেখান থেকে এই ভ্যানে উঠছি। আমার বাসা শনিরআখড়ায়। সেখানে আমরা মা আছে। আমি ঈদের সময় গ্রামে গেছিলাম।দুুপুরে করোনার টিকা দিতে বেরিয়েছেন শামসুল ইসলাম। তার হাতেই তার টিকার কাগজ। তিনি বলেন, এভাবে ভ্যানে যাওয়ায় ঝুঁকি আছে সেটা বুঝি কিন্তু উপায়ও তো নাই। রিক্সা ভাড়া আকাশচুম্বী, ভ্যানে তাও কিছুটা কম। এই মহাসড়কের রায়েরবাগে দায়িত্ব পালনকারী ডেমরা ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট সুলতানুল আরেফিন বলেন, চলাচলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে এবং সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিধিনিষেধ নিশ্চিতের চেষ্টা করছি আমরা। মানুষ নানান প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছে। তারা নিয়মের মধ্যে থাকছেন কি না তা দেখছি। মহাসড়কে আমরা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা এবং ইজিবাইক এ্যালাউ করছি না।এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে সরেজমিনে উত্তরা, এয়ারপোর্ট, গাবতলী, শ্যামলী, আসাদগেট, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, ধানমÐি, মালিবাগ, মগবাজার, কাকরাইল, পল্টন ও মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট নেই। কোন কোন মোড়ে চেকপোস্ট থাকলেও তাতে পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
মোটরসাইকেলে দু’জন এবং রিক্সায় দু-তিনজনও চলাচল করছেন। মোটরসাইকেলে দু’জন চলাচল করলেও পুলিশ তাদের দেখে অনেকটা নিশ্চুপ অবস্থায় রয়েছে। এমনকি মোটরসাইকেলে ডেকে ডেকে যাত্রী তুলতেও দেখা যায় অনেক রাইডারকে। তবে সড়কে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত গাড়ি। ফার্মগেট এলাকায় প্রায় ৩০ মিনিটের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত কয়েকদিন যেখানে পুলিশের চেকপোস্ট ছিল সেখানে গতকাল পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি।এছাড়া রাজধানীর কিছু কিছু সড়কে যানজট না থাকলেও কোথাও কোথাও সিগন্যাল লক্ষ্য করা গেছে। সড়কজুড়েই ব্যক্তিগত গাড়ি, রিক্সা আর মোটরসাইকেলের আধিপত্য। সড়কে মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কাওরান বাজারে কর্তব্যরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, রাস্তায় চলাচলে বিধিনিষেধ থাকলেও অনেকে বিনা প্রয়োজনেও রাস্তায় বের হচ্ছেন।আমরা এমন ক্ষেত্রে জরিমানা করছি। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছেন। জরুরী সেবায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা অবাধে চলাচল করতে পারছেন। এ বিষয়ে রমনা ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ রেফাতুল ইসলাম বলেন, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও দিনের পরদিন সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ নিশ্চিতে মাঠে থেকে কাজ করছে পুলিশ সদস্যরা। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এবং দুপুর ২টা থেকে সড়কে যতক্ষণ গাড়ির চাপ থাকে ততক্ষণ দুটি শিফটে কাজ করছে। বৃষ্টির জন্য ট্রাফিক সদস্যদের রেইন কোট ও ছাতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলামোটর সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা শফিকুল ইসলাম নামে এক পথচারী বলেন, এটার নাম বিধিনিষেধ ! সড়কে দেখেন কত গাড়ি চলছে। পুলিশের কোন বাধা নেই। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা না করে বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে। কষ্টে পড়ে মানুষগুলো সড়কে নামছে। তাই পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।এভাবে টানা লকডাউন থাকলে মানুষ না খেয়ে মরে যাবে।
বগুড়া অফিস জানিয়েছে, করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও বগুড়ায় যানবাহন ও জন চলাচল বেড়েছে। শহরের সড়কগুলোতে যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জন চলাচলও বাড়ছে। অনেক সময় সড়কে থাকছে যানজট। মহাসড়কে বাস ছাড়া অন্য যানবাহন চলাচল একইভাবে বাড়ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে ঈদের পর শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষেধের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম ২ দিন শহরে লোক চলাচল কম থাকলেও এখন তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে সড়ক ও এর দু’পাশের পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই যে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। লোকজনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ মানার অনীহা মনোভাবও বেড়ে চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো না। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা ফাঁকা রাখতেই যেন সব তৎপরতা। মঙ্গলবার শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের একাংশে ব্যাপক যানজট দেখা দেয়। সেখানে প্রায় ২০ মিনিটের বেশি একটি এ্যাম্বুলেন্সকে গুরুতর রোগী নিয়ে সাইরেন বাজাতে দেখা যায়। কবি নজরুল ইসলামের ওই স্থানে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পুলিশে তৎপর রয়েছে। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা যেন যানবাহন অতিক্রম করতে না পারে সেজন্য পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে।অথচ ওই সড়কের প্রবেশ মুখে পুলিশের তৎপরতা থাকলে যানবাহন মিছিল সেখানে যানজটে পরিণত হতো না।
যানজট ও যানবাহনসহ লোক চলাচল বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোঃ জিয়াউল হক জানান, কঠোর বিধিনিষেধ মানতে মোবাইল কোর্ট চলছে। বিনা কারণে রাস্তায় যেন কেউ বের না হয় এবং যানজটের মতো কোন পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে বিষয়ে আরও নজর দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে যানজটের বিষয়ে বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ জানান, শহরে কোন যানজট হয়নি। চেকপোস্ট চলাকালে অনেক সময় যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। এদিকে বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- ঈদ পরবর্তী কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সোমবার পর্যন্ত ৪ দিনে জেলাজুড়ে ১০৭টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সহায়তা করেছে। গত ৪ দিনে মোবাইল কোর্ট চলাকালে সময় মামলা হয়েছে ৬৬৩টি। এতে বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় জরিমানা করা হয় ৫ লক্ষাধিক টাকা। এদিকে শহরে শুধু যান চলাচলই বাড়েনি।বিভিন্ন এলাকায় অনেক দোকানপাট এক পাশ বন্ধ রেখে অর্ধেক সার্টার খোলা রেখে ব্যবসা করতে দেখা গেছে।