করোনা মোকাবেলায় কৃচ্ছ্রসাধনের সিদ্ধান্ত আপ্যায়ন ভাতাসহ অত্যাবশ্যক নয় এমন খাতে ব্যয় হ্রাস চলতি অর্থবছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের টার্গেট করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধের জালে আটকে আছে দেশ।
বর্তমানে দেশব্যাপী চলছে দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ। জরুরী পরিষেবা ছাড়া সব সরকারী-বেসরকারী অফিস বন্ধ। করোনার প্রকোপ মোকাবেলায় বন্ধ রাখা হয়েছে তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট কলকারখানাও। শুধু সচল রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাত। এই অবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রলম্বিত হবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে রাজস্ব আহরণেও। এ কারণে বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অর্থবছরের শুরুতে বড় ধরনের ব্যয় সঙ্কোচনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারী যানবাহন কেনা বন্ধ, বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত, আপ্যায়ন ভাতাসহ অত্যাবশ্যক নয় এমন খরচ কমানো, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড় স্থগিত ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কৃচ্ছ্র সাধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বাবদ গত অর্থবছরে সরকার প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করেছিল।
এবার এ নীতি বাস্তবায়ন করে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে চায় সরকার। সরকারের এ উদ্যোগকে অত্যন্ত ভাল ও সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।জানা গেছে, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার ঘোষণা দেয় সরকার। করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় গত বছর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জরুরী সেবা, কাঁচাবাজার, নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য সঙ্কুচিত হওয়ায় চাপের মুখে পড়ে অর্থনীতি। এরপর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে এক লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার জোগান দেয় সরকার।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পুরোদমেই চলছিল। রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমদানি বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি আগের চেয়ে বেড়েছিল। কিন্তু গত এপ্রিল মাস থেকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যাত্রাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টিকবে নাকি আবার খাদের মধ্যে পড়বে, তা নির্ভর করবে আমরা করোনা সঙ্কটকে কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে মোকাবেলা করছি। যত দিন করোনার টিকা পুরোপুরি দেয়া না হবে, তত দিন অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে প্রাণ নেই।
সরকার নিজেই বলছে, ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে আরও এক বছর লাগবে। এর মানে, এক বছরের আগে অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তিনি আরও বলেন, ‘ভোক্তা ব্যয় করতে না পারলে রাজস্ব আহরণ হবে না। লকডাউনে ভোক্তা ব্যয় করতে পারবে না। এতে রাজস্ব অর্জন কঠিন হবে। পাশাপাশি সরকারী অফিস বন্ধ থাকলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নে ধাক্কা খাবে। ফলে আগামী অর্থবছর এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই কাটবে।এদিকে নতুন লকডাউন কত দিন দীর্ঘায়িত হবে, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তের দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। কারণ শেষ অবলম্বন হিসেবে রাখা সঞ্চয়ে আবার আঘাত আসছে।করোনা মহামারীতে চলমান বিধিনিষেধের প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আয় সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে বড় অঙ্কের ঘাটতির মুখে তা সংশোধন করে ২৯ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি। সেই হিসাবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বইছে। নতুন করে অভিঘাতের মুখে পড়ছে ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট ও মাঝারি আকারের শিল্প। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। ফলে রাজস্ব আহরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এজন্য চলতি বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের ব্যয় সঙ্কোচনের পরামর্শ তাদের।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দিনই সরকার সরকারী ভ্রমণ ব্যয়ের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত করে। অর্থ মন্ত্রণালয় ওইদিন একটি পরিপত্র জারি করে এ স্থগিতাদেশ দেয়। এতে বলা হয়, শুধুমাত্র জরুরী ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় ভ্রমণ ব্যয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সকল প্রকার ‘রুটিন ভ্রমণ’ পরিহার করতে হবে। এছাড়া সরকারী ভ্রমণের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত থাকবে। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে সকল সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সরকার এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়। বাজেটে সরকারী চাকরিজীবীদের ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ খাতে ৫০ শতাংশ ব্যয় স্থগিতের কারণে সাশ্রয় হবে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ মেটাতে সরকার ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সেবার ভ্রমণ ব্যয় ৫০ শতাংশ স্থগিত করা হয়। এতে অর্থবছর শেষে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের কথা থাকলেও বিভিন্ন বিদেশী সেমিনার, মিটিং স্থগিত হওয়ায় সেটি প্রায় ২ হাজার কোটিতে পৌঁছায়। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেঁচে গিয়েছিল। ওই অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।চলতি অর্থবছরের প্রথম দিনে পৃথক আরেকটি পরিপত্র দিয়ে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গাড়ি কেনা বাবদ ৫০ শতাংশ ব্যয় স্থগিত করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কেনা বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এতে এ খাত থেকে সাশ্রয় হবে ৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। গত অর্থবছর কৃচ্ছ্র সাধনের আওতায় ৫০ শতাংশ গাড়ি কেনা স্থগিত করেছিল সরকার। গত অর্থবছরে গাড়ি কেনা বাবদ বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। এতে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে গত অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ ব্যয়ের ওপর অর্থ বিভাগ স্থগিতাদেশ দেয়। সংশোধিত বাজেটে এ স্থগিতাদেশ কার্যকর করা হয়। গত অর্থবছর সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। ফলে এ খাত থেকে ২৯ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। করোনার প্রভাব না কমলে আবারও গত অর্থবছরের মতো এডিপি বরাদ্দের ১৫ শতাংশ ব্যয়ে স্থগিতাদেশ আসতে পারে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যম পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় অব্যাহত রাখা হতে পারে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় স্থগিত করা হতে পারে।
নতুন অর্থবছরে এডিপির আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। ১৫ শতাংশ স্থগিত করা হলে এ খাত থেকে সরকারের সাশ্রয় হবে ৩৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা।এছাড়া প্রশিক্ষণ ব্যয়ের লাগামও টেনে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এ টাকা গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা হবে।জানতে চাইলে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বৈশি^ক মহামারীর মধ্যে সরকার ব্যয় কমানোর যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা যথার্থ। সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য আমাদের অনেক বেশি ব্যয় হয়। এসব ক্ষেত্রেও ব্যয় সঙ্কোচনের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘করোনাকালে অর্থনীতি স্থবির। রাজস্ব আয়ে শ্লথগতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় সঙ্কোচনের কোন বিকল্প নেই। সরকারের এ সংক্রান্ত উদ্যোগ অত্যন্ত ভাল ও সময়োপযোগী। তিনি আরও বলেন, এ বছর রাজস্ব আয় তেমন বাড়বে না। যেটা করতে হবে তা হলো, যোগ্য সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। তাহলে রাজস্ব জোগানে নিয়মিত করদাতাদের ওপর চাপ কমবে।