এ রাজত্বে তাহের রাজা, আর তাঁর ছেলেরা রাজ্যের বড় বড় দায়িত্বে। হীরক রাজার এই দেশে অনিয়মই নিয়ম। লক্ষ্মীপুরে যেন সেই জমিদারি প্রথা ফিরেছে। আর এর ছড়ি ঘোরাচ্ছে যুবলীগ, যার নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা পৌর মেয়র আবু তাহের ও তাঁর ছেলেরা। ফলে এখন জিম্মি জেলা আওয়ামী লীগ। নিপীড়নের শিকার হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা, স্কুলছাত্রী, কৃষক, গৃহিণী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও।
অভিযোগ রয়েছে, তাহেরপুত্র এ কে এম সালাহ্ উদ্দিন টিপু ও তাঁর দোসর সাবেক শিবির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান দেড় কোটি টাকায় বাগিয়ে নিয়েছিলেন যথাক্রমে জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির পদ। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সাড়ে তিন বছর ধরে একই পদে আছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় যুবলীগের শীর্ষ পদের দায়িত্ব শেখ পরিবারের সদস্যের হাতে আসার পর সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে সার্কুলার দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ।
এখন টিপু ও নোমান যুবলীগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়েছেন অদ্ভুত কৌশল। নিজেদের পদ ঠিক রেখে তাঁরা তৈরি করেছেন কমিটি-‘এ’, যা কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তরে পেশ করা হয়েছে। সাড়ে তিন বছরে তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ আকাশ সমান! তাই ‘এ’ কমিটি অনুমোদন না পাওয়ার ভয়ে তৈরি করেছেন কমিটি ‘বি’। সেখানে স্থান পেয়েছেন তাঁদেরই দোসর ও শিবির ক্যাডাররা। গত ২৯ এপ্রিল টিপুর স্বাক্ষরে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমাও দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, নতুন কমিটি-‘বি’-তে সহসভাপতির পদে প্রস্তাব করা হয়েছে তাহেরের ছোট ছেলে চিহ্নিত মাদক কারবারি আবু শাহাদাত শিবলুকে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী, ডাকাতি ও হত্যা মামলার আসামিও আছেন বেশ কয়েকজন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ত্যাগী নেতারা।
জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল হাসান পলাশ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি নব্বইয়ের দশক থেকে ছাত্রলীগ করেছি। আমরা দেখছি যাঁরা প্রস্তাবিত কমিটিতে আছেন তাঁরা কখনোই ছাত্রলীগ করেসনি। তাঁদের কেউ কেউ শিবিরের ক্যাডার।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, কমিটি-‘এ’-তে সভাপতি পদে টিপু আর সম্পাদক পদে নোমানের নাম পাসের চেষ্টা চলছে। তা সম্ভব না হলে তাঁদেরই ঘনিষ্ঠ শেখ জামাল রিপনকে সভাপতি ও চৌধুরী মাহমুদুন্নবী সোহেলকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি-‘বি’ দাখিল করেছেন তাঁরা। সোহেল ৫০ লাখ টাকার বিনিময় শিবির থেকে ছাত্রলীগের সভাপতি বনে যান বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ রয়েছে, সোহেলের বাবা একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন বিএনপি নেতা, ২০০২ সালে জেলা আওয়ামী লীগের অফিসে তালাও দিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় সোহেল ও তাঁর বাবার হাতে নিগৃহীত হন আওয়ামী লীগের শ খানেক নেতাকর্মী। সোহেল ও তাঁর বাবার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল হাসান পলাশ বলেন, ১৮ বছর লক্ষ্মীপুর জেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি পুনর্গঠন হচ্ছে না। একটি বিশেষ পরিবারের কাছে এখানকার আওয়ামী লীগ জিম্মি হয়ে পড়েছে। জেলা যুবলীগ গেল সাড়ে তিন বছরে থানা,পৌর অথবা ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। হঠাৎ আহ্বায়ক কমিটি করে, পরে তা ভেঙে দেয়। আবার টাকার বিনিময়ে নতুন কমিটি করে, এভাবে বাণিজ্য করে। রায়পুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মঞ্জুর হোসেন সুমন অভিযোগ করে বলেন, তারা জেলায় কমিটি বাণিজ্য করছে,
টিপু ও নোমান ৫৪ লাখ টাকা নিয়ে রায়পুর যুবলীগের উপজেলা কমিটি দেয়। আমি কেন্দ্রীয় যুবলীগকে বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করি। তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ায় কমিটির কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিয়া মোহাম্মাদ গোলাম ফারুক বলেন, ‘জেলা যুবলীগের নেতাদের অপকর্মের বিষয়ে আমি কয়েক দফা কেন্দ্র যুবলীগকে অবহিত করেছি। পেনডেমিক পরিস্থিতি চলে গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কথা বলব।’ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিন বলেন, লক্ষ্মীপুরে যুবলীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে টিপু-নোমানরা। কমলনগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন মাস্টার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ লক্ষ্মীপুরে একটি পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।’টিপু বাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে ধর্ষণ, দখল, মাদক, খুন, রাজনৈতিক সংঘর্ষসহ নানা অভিযোগ। আর এসব করে টিপু বনে গেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। সমপ্রতি অর্থ ও মানবপাচারের দায়ে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়া লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের সহযোগীদের মধ্যে নাম আসে টিপুর।
অভিযোগ আছে, বাবলুকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য এমপি পাপুলের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা নেন টিপু। তাঁকে একটি হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের জিপও কিনে দেন পাপলু। সম্প্রতি টিপুর এসব সম্পত্তির খোঁজে নেমেছে দুদক।
জানা গেছে, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান কেন্দ্রীয় যুবলীগের অফিসের পিয়ন থেকে দপ্তর সম্পাদক (এখন সাবেক) বনে যাওয়া কাজী আনিসের বিশ্বস্ত সহযোগী।
কাজী আনিসের সহযোগী ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গণমাধ্যমেও আসে তাঁর নাম। আনিসের সহযোগিতায় নোমান ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতা থেকে এক লাফে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বনে যান। পদ পেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের পাশাপাশি ঢাকায় ছয় তলা বাড়ি ও বেশ কিছু ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। নোমান এক সময় আনিসের মোবাইল শোরুম, বসুন্ধরা মার্কেটে দোকান ও গুলশানে নাভানা টাওয়ারে অবস্থিত দোকান দেখাশোনা করতেন।
গত ২২ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সউদিপ্রবাসী মোহাম্মদ হানিফের জমি দখল করে দোকান নির্মাণ করেন যুবলীগের আরেক নেতা। অভিযুক্তরা হলেন, জেলার কুশাখালী ইউনিয়নের ফরাসগঞ্জ এলাকার যুবলীগ নেতা আব্দুল করিম, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, জহির, কালামিয়া, জাহাঙ্গীর ও ইউসুফ। জানা গেছে, তাঁরা সবাই নোমানের লাঠিয়াল বাহিনী। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে লক্ষ্মীপুর কমলনগর উপজেলার বাসিন্দা বিধবা সালেহা বেগমের বসতবাড়ির, জমি ও গাছপালা নষ্ট করে পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল তৈরি করেন যুবলীগ নেতা আজাদ। ঘটনার সত্যতা শিকার করেছেন স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন মাস্টার।