এ এক ভিন্ন ধরনের মাদক। যা সেবনের পর হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যায়। কিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। নেশাকারীর চিন্তার পরিবর্তন ঘটে। এ নেশা অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে। সেবনকারীর দৃষ্টি ও শ্রুতির মধ্যে এক ধরনের উত্তেজিত ভাব তৈরি করে। অনেক আগের কথা মনে করিয়ে দেয়। পুরনো কষ্টকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়।
ভয়ঙ্কর এ মাদকের নাম এলএসডি। অন্য নাম এলএসডি-২৫, এসিড ও ডেলিসাইড। ছদ্মনাম- এমডিএ, এন, মাশরুম, সিলোসাইবিন ও এম-ডিমথাইলট্রাইপটানিয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে সুকৌশলে অনলাইনে বেচাকেনা চলছিল এলএসডির। এটি দেখে মাদক হিসেবে সন্দেহ করা কঠিন। নানা কৌশলে দেশে আনা হতো ভয়ঙ্কর এ মাদক। যারা বহন করতেন তাদের অনেকেই জানতেনই না যে এটি মাদক। আকর্ষণীয় ডাকটিকিট, কখনো স্টিকারসহ নানা চমকপ্রদ উপায়ে আমদানি করা হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আলোচনায় এসেছে এর নাম। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে এলএসডির আমদানি একেবারে নতুন নয়। আগে থেকেই এ মাদক ব্যবহার হচ্ছিল। এলএসডির ভয়ঙ্কর জগতে জড়িয়ে পড়েছে আরো অনেকে। এর একটি তালিকা রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
সূত্র মতে, ২০১৯ সালে রাজধানীর কাফরুলে পাঁচ গ্রাম এলএসডিসহ ইয়াসের রিদোয়ান আনাস নামের ধনাঢ্য পরিবারের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন কানাডা থেকে আনাস এলএসডি এনেছিলেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এ মাদক আর ধরা পড়েনি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে এই মাদক বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। অসংখ্য ক্রেতার নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পরবর্তীতে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
সূত্র জানায়, হাফিজের মৃত্যুর পর গ্রেপ্তারকৃত তিন শিক্ষার্থীর ফেসবুক গ্রুপ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত এক হাজার সদস্যের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে কমবয়সী নারীও রয়েছে। মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তারা ফেসবুক গ্রুপ, ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে পাওয়া ফোন নম্বরে অর্ডার নিয়ে থাকে। সেই নম্বর অনুযায়ী তাদের নিয়োগ করা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি সাপ্লায়ার হিসেবে কাজ করে।
লেনদেনও একইভাবে করা হয়। অধিকাংশ এলএসডি সেবনকারীই তরুণ শিক্ষার্থী। যাদের বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ইচ্ছা আছে তারাই এর প্রতি ঝুঁকছে। অন্যান্য ড্রাগ নেয়ার এক পর্যায়ে আগ্রহ জাগার পর তারা এটা নিয়ে দেখেন। এখন পর্যন্ত এলএসডি শহরকেন্দ্রিকই বিক্রি হচ্ছে। একাধিক এলএসডি বিক্রয়কারী ডিলারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারাও গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে একইভাবে ক্রয়-বিক্রয়ে জড়িত। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত তিন শিক্ষার্থীর মধ্যে দু’জনের পরিবার তাদের মাদকাসক্তের বিষয়টি আগে থেকেই জানতো। যদিও এলএসডি সম্পর্কে তারা তেমন কিছু জানেন না।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দু’জন গত এক বছর ধরে এলএসডি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত। আরেকজন অনেক আগে থেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মাদক বিক্রির পেজের নাম অনেক বেশি রহস্যজনক করতে ভুয়া একাউন্ট ‘আপনার আব্বা’সহ আরো বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে ক্রেতাদের ভিড়িয়ে থাকে। যে সকল ডিলারের সন্ধান পাওয়া গেছে- সেখানে অভিযান চালালে আরো ডিলারের সন্ধান বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এরাই বিশেষ পদ্ধতিতে এক ধরনের বিশেষ গাঁজা কেক তৈরি করে। সাংকেতিকভাবে এটাকে তারা ব্রাউনি বলে। গাঁজার পাতা পানিতে ফুটানোর পরে যে নির্যাসটা পায় সেটার সঙ্গে বাটার এবং অন্যান্য উপাদানের সংমিশ্রণে এ কেক তৈরি করে তারা। প্রতি পিস কেক দেড় থেকে দুইশ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
এ বিষয়ে রমনা জোনের এডিসি মিশু বিশ্বাস বলেন, অনেকেই আমাদের নজরদারিতে রয়েছেন। আরো একাধিক অভিযান চালানো হবে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় মামলা শেষে আগামী রোববার আদালতে তুলে রিমান্ড শুনানির পর বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে এ বিষয়ে আরো জানা যাবে।
এই ভয়ঙ্কর নেশায় যাতে সন্তানরা আসক্ত না হতে পারে সে ব্যাপারে তাদের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে পিতামাতাকে।