1. nagorikkhobor@gmail.com : admi2017 :
  2. shobozcomilla2011@gmail.com : Nagorik Khobor Khobor : Nagorik Khobor Khobor
সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :

ক‌্যান্সার চি‌কিৎসায় কলকাতার TATA হস‌পিটাল

নাগ‌রিক খবর ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২১
  • ৭৩১ বার পঠিত

TATA-  চি‌কিৎসা কর‌লেন ক‌্যান্সা‌রে আক্রান্ত জাহাঙ্গীর হো‌সেন – সফলতা পে‌য়ে‌ লি‌খে‌ছেন টাটা‌কে নি‌য়ে:

সূচনা:
২০১৯ থেকে আমি lower abdomen এ ব্যথায় ভুগতে থাকি। সাথে constipation ও পেটে গ্যাস জমে থাকা। পেটে বেশী গ্যাস জমার কারণে খেতে সমস্যা হতো, ঘুমোতে সমস্যা হতো এমনকি রাতে বিছানায় এপিঠ-ওপিঠ করতেও ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতাম। বাংলাদেশে বিশাল সব ডিগ্রিধারী গ্যাস্ট্রোর ২-জন সহকারী অধ্যাপক, ২-জন সহযোগী অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপককে পর্যায়ক্রমে দেখাই। উপসমে ব্যর্থ হয়ে কলকাতা Apollo-তে বিখ্যাত Gastroenterologist Prof Dr Goenka-কে দেখাই। এই ৫-ডাক্তার মিলে আমার নানাবিধ টেস্ট করে, যাতে প্রায় ২/৩-লাখ টাকার মত ২-বছরে খরচ হয়। টেস্টের মধ্যে প্রধান ছিল ৩-বার পেটের সিটি স্কান, ৩-বার colonoscopy, ১-বার endoscopy-সহ হরেক রকম টেস্ট। কিন্তু সব রিপোর্ট Normal এলে ডাক্তারগণ আমার রোগকে IBS, একজনে আবার ‘মানসিক’ সমস্যা বলে উড়িয়ে দেন। সর্বশেষ whole abdomen সিটি স্কানে কিছুটা abnormal দাগ খুঁজে পেলে ডাক্তার আমাকে তার পছন্দমত ক্লিনিকে Laparoscopy করতে বলেন। Laparoscopy ডাক্তারকে তিনি ফোনও করে দেন যে, অমুক নামের একজন রোগী পাঠাচ্ছেন তিনি। কিন্তু ক্লিনিকে গিয়ে তার পরিবেশ পছন্দ না হওয়াতে, আমি ও আমার স্ত্রী ওখানে থেকে এক রকম পালিয়ে আসি। যদিও Laparoscopy-র ডাক্তার ফোন করে আমাকে খুঁজতে থাকেন।

খুঁজতে খুঁজতে পছন্দের একজন ইয়াং laparoscopist পেয়ে যাই। তিনি একটি বেসরকারি মেডিকেলের সহকারী অধ্যাপক। তার মেডিকেলের ক্লিনিকে ভর্তি হই, তিনি প্রায় ৪-ঘন্টা ধরে সার্জারি করেন ও lower abdomen এ নানাবিধ অসঙ্গতি দেখতে পান, যার ৪-ঘন্টার ভিডিও তিনি ধারণ করে আমাদের দেখতে দেন। টিউমার খুঁজে পেয়ে তার স্যাম্পল এনে বায়োয়েপসি করান। তার ক্লিনিকে বায়োয়েপসি ‘পজেটিভ’ এলে তিনি আবার ২য় কোথাও বায়োয়েপসি করার পরামর্শ দেন। ঐ ক্লিনিকে সাকুল্যে আমার ১,৩৫,০০০/- টাকা খরচ হয় ১০ দিনে। আমাদের ইচ্ছেমত ২য় স্থানে বায়োয়েপসি করলেও, রিপোর্ট পজেটিভ আসে। আমার এক পাইলট আত্মীয় থাকাতে কলকাতাতে তার ফ্লাইটে একটা স্লাইড স্যাম্পল পাঠিয়ে দেই। ছোটভাই সমু তা কলকাতার টাটায় টেস্ট করতে দিলে তার রিপোর্টও পজেটিভ আসে। তখন তিনি আমার ক্যান্সার কনফার্ম করেন ও ভেতরে নানাবিধ অসঙ্গতি, আমার ওজন ১০-কেজি কমে যাওয়া, শারিরীক দুর্বলতা, খেতে না পারা ইত্যাদি দেখে ‘ক্যান্সারটি জটিল’ বা ৩য়/৪র্থ পর্যায়ের বলে অনুমান করেন। ডাক্তার সময় নষ্ট না করে আমাদের কুইক ক্যান্সার চিকিৎসার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমরা দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা না করিয়ে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

২. চিকিৎসার খরচ ও খোঁজ খবর
———————————————–
আমার একমাত্র কন্যাটি উচ্চাভিলাসী। তাই ব্যাংককের বারমুনগ্রাদ ও সিঙ্গাপুরের মাউন্ড এলিজাবেথে যোগাযোগ করলো সব কাগজপত্র পাঠিয়ে। ভিডিও কলে কথা বললো ডাক্তারের সাথে। কিন্তু ভিসা আর ফ্লাইট বন্ধ থাকাতে তারা “সরি” বললো। তবে পরামর্শ দিলো, যদি আমরা চাটার্ড ফ্লাইটে আসতে চাই, তবে ঢাকার দূতাবাসকে তারা “জরুরী ভিসার” জন্য অনুরোধ করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ৩-জনকে ১৪-দিন নিজ খরচে তাদের নির্ধারিত হোটেলে কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে। চিকিৎসা শুরু হবে ১৪-দিন পর। কন্যা খোঁজ নিয়ে জানালো, চাটার্ড ফ্লাইটের ভাড়া প্রায় ৩০,০০০ ডলার। আমি সৎ মধ্যবিত্ত মানুষ। আমার পক্ষে কি ত্রিশ হাজার ডলার ভাড়ার ফ্লাইটে যাওয়া সম্ভব? কন্যাকে বললাম, ভারতে চেষ্টা করো। তোমার মা-তো ভারতে চিকিৎসা করেই তার কিডনির রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হলো। চেন্নাইর Apollo একটা চিকিৎসা বাজেট দিলো ১৮,০০০ ডলারের। বেলডাঙার রফিক ভাই আর মোর্শেদা বললো – “বোম্বের টাটায় যান। সেখানে চিকিৎসা ভাল টাকা কম লাগে। মোর্শেদা নিজে তার চিকিৎসা করিয়েছে বোম্বের টাটায়”। কলকাতার ছোটভাই ‘সমু’ বললো – দাদা কলকাতা আসুন। এখানের TATA আর বোম্বের টাটা একই। একই protocol এ তারা চিকিৎসা করে। এ করোনাকালে বোম্বে গিয়ে কাজ নেই। রিস্ক!

৩. ভারতে যাওয়ার ভিসা জটিলতা
————————————————
নিজ, স্ত্রী আর কন্যার E-পাসপোর্ট জমা দিলাম ভারতীয় ভিসা সেন্টারে মেডিকেল ভিসার জন্য। সাথে ভারতের হাসপাতালের invitation letter এবং বাংলাদেশের সকল ডাক্তারি কাগজপত্র। ৫-দিন পর ভিসা দেয়ার টোকেন দিলো তারা। কিন্তু ৫-দিন পর ৩-টা পাসপোর্টই ফেরত দিলো ভিসা ছাড়া। বিস্মিত হলাম ভিসা না পেয়ে। কারণ ১৯৯৯ সন থেকে অন্তত ১০০-বার ভারতে গিয়েছি আমি আমার পরিবারসহ। কখনো ভিসা refuse হয়নি। পুরনো পাসপোর্টগুলোতে নানা দেশের ভিসা লাগানো। সাথে ১৫-লাখ টাকার ব্যাংক statement. কোথায় গলদ বুঝতে পারলাম না। সর্দি-কাশি নয়, ক্যান্সার রোগের treatment এর ভিসা চাইছি। ভিসা পাইনি শুনেই যমুনার IVAC গেটে ঘিরে ধরলো দালালরা। কেউ বললো ৪-দিনে ভিসা করে দিতে পারবে, কেউ বললো ১-দিনে। এবং আজই ১-ঘন্টার মধ্যে নতুন invitation letter এনে দিতে পারবে তারা। যেখানে আমার invitation letter পেতে লেগেছিল ৪-দিন। নতুন invitation letter আনতে আবার আমার ৪-দিন লাগবে, ভেবে যমুনার লেভেল-৪ এ দালালদের অফিসে গেলাম। ১-দিনে ভিসা করে দেবে এ জন্য প্রতিজনে ৩০-হাজার টাকা চাইলো তারা। টাকা অগ্রিম দিতে হবে। কাল জমা করলে পরশু ভিসা পাবো। আর ৪-দিন পর দেবে যারা, তারা চাইলো দশ হাজার করে মোট ত্রিশ হাজার টাকা। দরকষাকষি করে ২৫-হাজার টাকায় রফা হলো ৩-পাসপোর্টের। সত্যি, হাওড়ার কোন অখ্যাত হাসপাতাল থেকে ১-ঘন্টার মধ্যে নতুন invitation letter আনলো তারা ই-মেলে। আবার নতুন ফর্ম, কাগজপত্র সব সেট করে ফেললো বিকেল ৪-টার মধ্যে। কাল নতুন করে জমা দিতে হবে। জমার পর ৩-টা টোকেন দিতে হবে তাদের হাতে, যাতে তদবির করে তারা ৪-দিনেই পাসপোর্ট বের করতে পারে ভিসাসহ। ২৫,০০০-টাকা অগ্রিম দিতে হলো তাদের শর্ত মোতাবেক।

পরদিন নিজে জমা দিলাম ৩-পাসপোর্ট। টোকেন দিয়ে দিলাম দালালদের হাতে। ওদিকে আমার laparoscopy করেছিলেন যেই মানবিক ডাক্তার, তিনি বার বার তাগাদা দিতে থাকলেন আমার কন্যাকে, কেন আমরা এখনো দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা শুরু করাচ্ছিনা! ভিসা পাওয়া না গেলে কাল বিলম্ব না করে এখানেই যেন treatment শুরু করে দেই, কারণ আমার ক্যান্সারের stage হয়তো ৩য় বা ৪র্থ স্তরে চলে গেছে, তাই লেট করা চলবেনা। দুয়েকদিন পর পর ডাক্তার ফোনে খোঁজ নিতে থাকেন আমার, যে আমি আছি নাকি গেছি (কলকাতা কিংবা পরপারে!)। ৪-দিন পর দালাল দুটো টোকেন হাতে দিয়ে বললো, আপনার ও আপনার স্ত্রীর ভিসা হয়েছে। মেয়েরটা দুয়েকদিন পর হবে। কারণ পেশায় সে ‘মিডিয়া কর্মী’। তাই একটু দেরী হচ্ছে। আপনাদের দুজনেরটা নিয়ে আসুন। ১৫ নভেম্বর ২০২০ দুপুর ১-টায় দুটো পাসপোর্ট হাতে পেয়েই যমুনার সামনে গিয়ে ১৭ নভেম্বরের টিকেট করলাম কলকাতার। কারণ করোনা টেস্ট করতে হবে। ঐ দিনই দুপুর আড়াইটায় মহাখালী সরকারি করোনা টেস্ট সেন্টারে গেলাম টেস্ট করাতে। ওরা জানালো পরদিন ৩-৪-টার ভেতর রিপোর্ট পাবো তথা SMS যাবে আমাদের মোবাইলে। কিন্তু ১৬ তারিখ ৪টা, ৫টা, ৬টা বাজে, SMS আর আসেনা। কাল সকাল ৯-টায় ফ্লাইট। বাসা থেকে যাবো সকাল ৬/৭ টায়। আজ রিপোর্ট না পেলে কাল যাওয়া বাতিল। টিকেটের টাকাও ফেরত দেবেনা। আগেই বলে দিয়েছে Travel Agent. মেয়ে নিজে ও তার টিভি চ্যানেলের ‘নিউজ হেড’কে দিয়ে দুতিনবার ফোন করালো ডিজি হেলথ অফিসে। অবশেষে সন্ধ্যে ৭-টায় কাঙক্ষিত SMS এলো। দুজনেরই করোনা ন্যাগেটিভ।
:
৪. কলকাতার TATA-য় ক্যান্সার চিকিৎসার সাতকাহন:
১৭.১১.২০২০ কলকাতা নিউটাউনে পৌঁছলাম আমরা দুজনে। ১৯ তারিখ আমাদের আগাম appointment করে রেখেছিল কলকাতার ছোটভাই “সমু”! করোনার কারণে অনেকটা অপরিচিত বোম্বের টাটার চেয়ে কলকাতার টাটাতেই শুরু করলাম চিকিৎসা। ১৯ তারিখ প্রাইভেট হিসেবে দেখালাম ছশ টাকা ভিজিটে। ডাক্তার কতগুলো blood test ছাড়াও প্রধান টেস্ট PET CT scan করাতে বললেন। কিন্তু টাটায় পেট সিটি স্কানের ডেট পেলাম ২৫ তারিখ। চার্জ ২২,৭০০/- টাকা। যার রিপোর্ট পেলাম আবার ৫-দিন পর। রিপোর্টে কোলনের hepatic flexure এ ক্যান্সার মার্ক করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো আবার colonoscopy করা হবে। এ টেস্টের জন্য আবার করতে হবে করোনা টেস্ট। টাটায় করোনা টেস্ট ৯৫০ টাকা করে। তাই করে ১১,০০০/- টাকায় করলাম colonoscopy. তার রিপোর্ট পেলাম ৪/৫ দিন পর। এ রিপোর্ট বলা হলো, কোলনে কোন ক্যান্সার বা পলিপ নেই। ৪-ডাক্তারের টিম পড়লেন গভীর সমস্যায়। আমার ক্যান্সারের রুট কই ধরতে পারছেন না তারা। যদিও বাংলাদেশ ও টাটার প্রথম স্যাম্পলে রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। কিন্তু কোলন থেকে আনা স্যাম্পলে রিপোর্ট ন্যাগেটিভ। MDT team সিদ্ধান্ত নিলো রুট খুঁজতে আবার diagnostic laparoscopy করবে তারা। এ টেস্টে খরচ ১৮,০০০ টাকা। আবার করোনা টেস্ট, জরুরী তাই ২৫০০ টাকা। এই প্রথম হাসপাতালে ভর্তি। ১৯.১২.২০২০ টেস্ট হলো আমার। সব রিপোর্ট নিয়ে বসলেন MDT tumor board. এবার সিন্ধান্ত হলো EUS টেস্ট করাবেন তারা rule out gallbladder & pancreatic source বা রুট খুঁজে বের করতে।
:
এসব করতে করতে চলে গেল প্রায় দুমাস। এবার MDT team সিদ্ধান্ত নিলো CRS+HIPEC সার্জারী করবে তারা। যাতে সার্জনের সাথে ‘রোবটিক আর্ম’ ব্যবহার করা হবে। ঐ আর্মে পেরিটনিয়ামে ছড়ানো ছোট-বড় এমনকি সর্ষে দানার মত ছোট সিস্ট তথা পলিপ-গুলোকেও খুঁজে বের করে রিমুভ করবে। সাথে সাথেই ওখানে ‘লোকাল ক্যামো’ দিয়ে দেবে। কেবল CRS+HIPEC সার্জারীতে খরচ হবে ৭-সাত লাখ টাকা। অপারেশন করবেন Dr Bipradas Roy ও তার টিম।
:
৮ জানুয়ারি ২০২১ অপারেশন হবে, তাই ৬ জানুয়ারি ভর্তি হলাম হাসপাতালে। সেখানে নানাবিধ টেস্ট করালেন তারা। কেবল Eco-টা করে আনতে হলো পাশের OHIO হাসপাতাল থেকে। কারণ টাটার Eco মেশিন নষ্ট। অপারেশনের দুদিন আগ পর্যন্ত হার্ট, oncologist, এ্যানেসথেসিয়া, সাাইক্রিয়াটিস্টসহ নানাবিধ ডাক্তার এলেন বেডে। তারা নানারূপ কথা, নির্দেশনা আর অভয় দিলেন। বিশেষ ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেতে দিলেন ৩-বেলা। ৮ তারিখ সকাল ৬-টায় গরম জলে স্নান করিয়ে বিশেষ অপারেশনের ড্রেস পরিয়ে ৭-টার দিকে আমাকে ঢোকানো হলো অপারেশন টেবিলে। টেবিলে বসিয়ে anesthesiologist বললেন, আপনার পিঠের মাঝামাঝি স্পাইনাল কর্ডে পরপর ৫-টা ইঞ্জেকশন দিতে চাই আমি। এতে কিছুটা ব্যথা লাগবে। কিন্তু আপনার জটিল ও বড় অপারেশনের পর যে প্রচন্ড ব্যথা হবে, তা কম করে রাখতেই মূলত এ ইঞ্জেকশন, আপনি সম্মতি দিলেই আমি ঐ ৫টা ইঞ্জেকশন এখন দেব। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে, পিঠের মাঝে পরপর ৫টা ইঞ্জেকশন পুশ করলেন তিনি। বেশ ব্যথা পেলাম তাতে। এরপর শোয়ানো হলো বেডে। একজন মহিলা anesthesiologist বললেন, আপনার নাকে একটা মাস্ক ধরবো। তাতে ফুলের ঘ্রাণ পাবেন আপনি। দেখুনতো পাচ্ছেন কিনা। বললাম হ্যা পাচ্ছি। ঐ ঘ্রাণেই ঘুমিয়ে গেলাম আমি সকাল সাড়ে সাতটার দিকে।
:
সকাল ৮-টায় নাকি আমার অপারেশন শুরু হলো। শেষ হলো রাত ৯-টায়। যা মনিটরে দেখানো হচ্ছিল বাইরে অপেক্ষাগারে অবস্থানকারী আমার স্ত্রী, ছোটভাই সমু ও তার স্ত্রী প্রতিমাকে। রাত নটায় থিয়েটার থেকে বের করে আমাকে নেয়া হলো ICU-তে। চেতনা ফিরে এলো পরদিন বিকেলে মানে ৯-তারিখ। ICU-ছটি বেড। একদিকে ৩-টা, বিপরীত দিকে ৩-টা। প্রত্যেক বেডের পাশে নার্স দাঁড়ানো বা বসা। পুরো শরীরে ইসিজিসহ নানাবিধ যন্ত্রপাতি সজ্জিত। কেবল ওপর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া শরীর বা ঘাড় ঘোরানোরাাও কোন উপায় নেই। এক ফাঁকে নাকি ২-মিনিটের জন্য আমার স্ত্রীকে ডেকে আনলো আমার চেতনা ফরার পর, তাকে দেখতে পাইনি আমি। কারণ আমি তাকিয়ে ছিলাম আকাশ তথা ছাদের দিকে। কে এলো বা গেলো তা বোঝার ক্ষমতা তখনো হয়নি আমার। মনে হচ্ছে অনেক কষ্ট, অনেক বোঝা পুরো শরীরে। আহ! যদি এর চেয়ে অপারেশন থিয়েটারেই মারা যেতাম। তবেতো এতো কষ্ট সইতে হতোনা।
:
ওখানের সব ক্যান্সার রোগী। রাত দুটোর দিকে আমার বিপরীত বেডের নারীটি মারা গেলেন। নিজে চোখ দিয়ে তাকাতে পারছিলাম না। নার্স, ডাক্তারের কথাবার্তা, ডেথ সার্টিফিকেট বানানো, ডেড বডি বের করার আওয়াজ সব শুনে বুঝতে পারছিলাম সন্ধ্যা থেকে অনবরত ব্যথায় চিৎকার করা নারীটি মারা গেছেন। তখনো তেমন ভয় পেলাম না। রাত ৪-টার দিকে পাশের বেডের পুরুষটির শ্বাসকষ্ট প্রচণ্ড হলে নার্সরা ডাক্তারকে ডাক দিলো। সবাই মিলে তার বুক চেপে, ইলেকট্রিক শক দেয়ার পর ঘন্টা খানেকের মধ্যে মারা গেলেন তিনিও। ডেড বডিটি পর্দা দিয়ে ঢাকা। কিন্তু আমার পাশেই সে অবস্থান করছে। কি কারণে যেন তাকে নেয়া হচ্ছেনা। এবার ভয় ঢুকলো আমার। নার্সরা কে কোথায় বসে যেন ঘুমে ঢুলছে দেখতে পাচ্ছিনা আমি। আস্তে আস্তে ডাকলাম – সিস্টার সিস্টার! একজন পুরুষ নার্স সারা দিলো। বললাম ভয় করছে আমার! আপনি কই! সে বললো এইতো এখানে। বললাম প্লিজ আমার কাছে চেয়ারটা টেনে বসুন। তই করলো সে। ছটার দিকে ডেডবডি বের করা হলো আমার পাশ থেকে।
:
৩-দিন ICU-তে থাকাকালীন দেখলাম কোন কোন নার্স রাতে মোবাইলে চটুল গান শোনে। এসব কষ্ট, কাতরানো আর মৃত্যুর মাঝে মানুষ কিভাবে গান শোনে বুঝতে পারলাম না আমি। ৩-দিন পার হলে আমাকে ICU থেকে স্থানান্তর করা হলো SDO-তে। এটাকে সেমি ICU বলা যেতে পারে। টাটায় ভর্তিকৃত সব রোগীর সাথে একজন attendance থাকতে হয়। ৮-তারিখ থেকে আমার স্ত্রী attendance হিসেবে ICU-এর অপেক্ষাগারে সোফা বা চেয়ারে বসে কাটাতে থাকলেন। টাটার নির্দেশনা হচ্ছে বাড়ির লোক ২৪-ঘন্টা ওখানে থাকবে। কখন রোগীর কি হয়, বা কি লাগে বলাতো যায়না। অথচ একজন মানুষের জন্য এভাবে কেবল বসে ১০/১৫ দিন থাকা খুবই কষ্টকর। ৩-দিন SDO-তে থাকার পর নেয়া হলো GI-Surgery-তে। সেখানেও নার্সরাই সব দেখাশোনা করে, রোগীর সাথে কাউকে থাকতে দেয়না। সেখানে রইলাম ৫-দিন। ICU, SDO এবং GI বেডে থাকাকালীন প্রত্যহ উষ্ণ জলে ডেটল দিয়ে পুরো শরীর মুছিয়ে তারপর olive oil মেখে দিতো নার্সরা। এরপর পিঠ ও শরীর ম্যাসেজ করে দিতো। সার্জন ছাড়াও সব রকমের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসতো ২/৩ ঘন্টা পর পর। এমনকি কি কি খাবো তার লিস্ট করতো রোগী তথা আমার মতামত নিয়ে। বিকেলে চা নাকি কফি খাবো, দুধ নাকি ব্লাক কফি তাও জানতে চাইতো। সেভাবে খাবার পরিবেশন করতো ঠিক সময় মতো। শরীরে স্যালাইন সেট, ও বিবিধ যন্ত্রপাতিসহ দুজন নার্স দুহাত ধরে দুবেলা হাঁটাতো হাসপাতাল করিডোরে। পা দুটো ম্যাসেজ করে দিতো একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। মাঝে ২-বার সেভ করে দিয়েছে টাটার নাপিত। যদিও ওয়ান টাইম রেজার কিনে দিতে হয়েছে আমার স্ত্রীকে। ডাক্তাররা portable X-ray, ECG, Eco ইত্যাদি মেশিন এনে বেডেই নানাবিধ টেস্ট করতো। ডেইলি ২/৩ বার রক্ত নিতো টেস্ট করতে। blood pressure, diabetic test করতো ৩/৪ ঘন্টা পর পর।
:
টাটা হাসপাতালে বাঙালি, উড়িয়া, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও কেরালার নার্সরা কাজ করে। আমার ভাগে কেবল ২-দিন কেরালার নার্স পড়েছিল। তার আচরণ, সেবা সত্যি অতুলনীয়। সে আমার গা মুছিয়ে দেয়ার সময় অতি যত্নে নাভীর গোড়া এমনকি পুরুষাঙ্গে লাগানো পাইপটাসহ পুরুষাঙ্গ মুছিয়ে দিয়েছিল। মেঘালয়, মনিপুরের মঙ্গোলীয় চেহারার নার্সদের ব্যবহারও ভাল। ডাক দিলেই দৌড়ে আসে। তবে তারা ততটা দক্ষ নয়। কেউ কেউ সম্ভবত একদম নতুন বা প্রাইভেট নার্সিং কলেজ থেকে পাশ করে এসেছে। ক্যানোলা করতে কারো কারো ২/৩ বার চেষ্টা করতে হয়েছে। একবারে করতে পারেনি। বাঙালি নার্সগুলো অনেকটা বাংলাদেশী নার্সদের মত। জোরে, রুক্ষ ভাষায় কথা বলে। ভাল করে বুঝিয়ে বলেনা। কোন কথা না বুঝলে বিরক্তি প্রকাশ করে। প্রায় সময় মোবাইলে বাইরে কথা বলে, হাসি-তামাশা করে মোবাইলে। ডাকলে দেরী করে আসে।
:
কলকাতার টাটায় চিকিৎসা খরচ নাকি বোম্বের টাটার চেয়ে কিছুটা বেশী। তবে চেন্নাইর এ্যাপোলো থেকে কম কিন্তু ভেলোর থেকে বেশ বেশী। যেমন পেট সিটি স্কানে ভেলরের চার্জ ১১,০০০/- রুপি কিন্তু কলকাতা টাটায় ২২,৭০০/- রুপি। হাসপাতালে ভর্তি হলে প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় নানাবিধ জিনিস টাটার ফার্মেসি থেকে সাপ্লাই দেয়। যার দাম বাজার দর থেকে বেশ বেশী। যেমন হ্যান্ড গ্লাভস প্রতিবক্স টাটা ফার্মেসিতে ৯০০ রুপি কিন্তু বাইরে ৫০০/৬০০ রুপি। আর নার্সরা এতো হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করে যে তা এনে কুলানো যায়না, ক্লিনার বা চা দিতে এসেও রোগীর ৯০০ টাকায় কেনা হ্যান্ড গ্লাভস থেকে সবাই একটা দুটো করে নিয়ে যায়। ১৬ দিনে টাটা হাসপাতালে ভর্তিতে আমার অন্তত ১২ বক্স গ্লাভস এভাবে গিয়েছে। একটা খালি চায়ের কাপ ফেলতেও নার্সরা একটা গ্লাভস ব্যবহার করে। এভাবে নার্স ও স্টাফরা রোগীর টাকা অপচয় করে। আমার ঘরে পেস্ট ব্রাশ আছে তা স্ত্রী বিকেলে নিয়ে আসবে, বলার পরও নার্স টাটা ফার্মেসি থেকে তা আনালো এবং একটা ব্রাশ ধরলো ২০০ টাকা। আমার জন্য ইনডেন্ট দিয়ে ৩-টা ইনসুলিন আনালো নার্সরা। কিন্তু তার একটাও ব্যবহার করলো না। হাসপাতাল ছাড়ার সময় যখন অব্যবহৃত সব ঔষধপত্র ফেরত নিতে এলো ফার্মেসি থেকে লোক, সে আর ঐ ৩টা ইনসুলিন ফেরত নিলোনা এই কারণে যে, এর ‘সিল’ নার্সরা খুলে ফেলেছে, তাই ব্যবহার না হলেও তা ফেরত নেয়া যাবে না। দাম আমার দিতে হলো!
:
মোটামুটি এসব ছোটখাটো প্রবলেমগুলো বাদ দিলে টাটা ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য মন্দ নয়। ওখানে কমদামে খাবার ক্যান্টিন আছে। যাতে ৬০/৭০ টাকায় লাঞ্চ ডিনার করা যায়। ডরমেটরিতে ২০০/৩০০ টাকা দৈনিক ভাড়ায় রোগীর attendance থাকতে পারে। তা ছাড়া নিউটাউনে দৈনিক ৯০০-১০০০ টাকায় ভাল এসি রুম পাওয়া যায়। আর ২-কিমি দুরের মুসলিম এলাকা লস্করি হাটে ৪০০-৫০০ টাকায় ঘর পাওয়া যায়। যা অনেকটা হোটেলের মত। নিউ টাউনে মাস হিসেবে ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যায়। যার ভাড়া ১০-১৫ হাজার টাকা মাসিক। আমি যে ফ্ল্যাটে থাকতাম, তা একজন ডাক্তারের। ৩-রুমের ফ্ল্যাটের ভাড়া ছিল ১৪,০০০/- রুপি মাসিক। ফ্লাটে খাট, বিছানা, ফ্রিজ, টিভি, এসি আছে।
:
আমার অপারেশন হয় ৮.১.২০২১ ও চিকিৎসা শেষে ফিরে আসি ৭.২.২০২১ তারিখ। পুনরায় চেকাপে যাই গত ৮.৪.২০২১ আর ফিরে আসি ১১.৪.২০২১। ডাক্তার আমাকে দেখে, ৫-রকম ব্লাড টেস্ট করে বলেন যে, আমি এখন ভালই আছি। তাই এখন আর কোন টেস্ট করতে হবেনা। পুনরায় ১৫.৭.২০২১ তারিখ নতুন appointment দিয়েছে। যখন আবার সিটি স্কান করে দেখবে। এখন অপেক্ষায় আছি জুলাইর ১৫ তারিখের।
:
যাওয়া ও আসা ২ সময়েই করোনা টেস্ট করাতে হয়। আর যেতে বাড়তি করতে হয় ভারতীয় এয়ার সুবিধা apps পুরণ। ভাড়া ঢাকা থেকে এয়ারে ৬৮০০-৭২০০ টাকা। তবে আগে টিকেট করতে হয়। ২/১ দিন আগে টিকেট করলে সাধারণত ভাড়া বেশী লাগে। এমনকি ১১,০০০/- টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। কলকাতা থেকে ভাড়া একটু কম। কিন্তু গত ১১.৪.২০২১ এলাম প্রতিজন ৭৫০০ রুপি করে। কারণ টিকেট করেছি মাত্র দুদিন আগে। আর বিমানে ২ সিটের মাঝে ১ সিট খালি রাখে বলে এখন ভাড়াটা বেশী।
:
আমার চিকিৎসায় আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়াসহ মোট ১৪-লাখের মত খরচ হয়েছে। আর কষ্ট করেছে আমার স্ত্রী। আমি যে ১৩/১৪ দিন ICU, SDO এবং GI unit এ ছিলাম, এ কদিন আমার স্ত্রী দিন-রাত ওয়েটিং রুমে চেয়ার বা সোফায় বসেই কাটিয়েছেন। রাতে সে ঐ সোফায়ই ঘুমাতো। এ ব্যবস্থাটা টাটায় আরো আধুনিক করা উচিৎ বলে মনে করি। যতবার ডাক্তার দেখিয়েছি ততবার কলকাতার ছোটভাই সমু উত্তরপাড়া থেকে তার কাজ ফেলে টাটায় আসতো। আর মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার অনেক দূর থেকে রফিক ভাই আর মুর্শিদা আমাকে টাটায় দেখতে এসেছেন মোট ৫-বার। অত দূর থেকে গাড়ি করে আসতে হয়েছে তাদের কেবল আমার মনোবল বাড়াতে। ওরা বারাসাতে এক বন্ধুর খালি বাড়িও ফ্রিতে ঠিক করেছিলো আমার জন্য। মালদা থেকে প্রত্যহ একটা হাসির জোকস পাঠাতো আমায় Paromita Chaudhury Mandal ( টুপুর) কেবল আমার মন ভাল রাখার জন্য। আর আমার ফেসবুক বন্ধুরাতো শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সব সময়, সাহস জুগিয়েছেন অহরহ। আমার ভাই-বোন, স্বজন আর পরিবারের কান্নার কথা আর নাইবা তুললাম এখানে। কারণ বাংলাদেশের একজন Gastroenterologist, যাকে সর্বশেষ দেখাই আমি, তিনি আমার কন্যাকে একান্তে ডেকে বলেছিলেন – “তোমার বাবা আর মাত্র সপ্তাহ য়েক বাঁচবে”!

লেখক: জাহাঙ্গীর হো‌সেন

ফেসবুক টাইম লাইন থে‌কে সংগৃ‌হিত

https://www.facebook.com/JahangirHossainDDMoEduGoB

 

CONTACT INFORMATION:

TATA CANCER HOSPITAL

14 MAR (E-W), New Town,
Rajarhat, Kolkata 700 160
West Bengal, India.

Phone: +91-33-6605 7000
E-mail: info@tmckolkata.com

 

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2020 nagorikkhobor.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com